ধর্মান্তরকরণ
২২ ডিসেম্বর ২০১৪ধর্মান্তরকরণ বা পুনর্ধর্মান্তরকরণ ভারতের মতো দেশে কোনো নতুন ঘটনা নয়৷ ভারতের মতো বহু সম্প্রদায় ও বহু ধর্মের দেশে এমনটা হতেই থেকেছে৷ একসময় যেমন শাসক সম্প্রদায়ের চাপের মুখে ধর্মবদলের ঘটনা ঘটেছে, তেমনই স্রেফ বিধর্মী শাসকের রাজত্বে নিরাপদে থাকার আকাঙ্খা, বা সামাজিক-অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়ার আশা থেকেও বহু অভাবী মানুষ স্বধর্ম ছেড়ে পরধর্মের শরণ নিয়েছেন৷
ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের আগ্রায় সাম্প্রতিক ধর্মান্তরকরণের ঘটনাটির কথাই ধরা যাক৷ ৫০টির মতো দরিদ্র মুসলিম পরিবার, যারা রাস্তায় পড়ে থাকা কাগজ কুড়িয়ে কায়ক্লেশে জীবিকা নির্বাহ করে, তারা সপরিবারে প্রায়শ্চিত্ত করে হিন্দুধর্মে ফেরত এসেছে৷ এখানে ফেরত আসার বিষয়টি লক্ষ্যণীয়৷ তার অর্থ, কোনো এক সময়ে এঁরা সবাই হিন্দু ছিলেন৷ সম্ভবত অভাবের তাড়নাতেই, একটু স্বচ্ছলতার আশায় ওঁরা ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন, কিন্তু ওঁদের জীবিকাই বলে দিচ্ছে, সে আশা পূরণ হয়নি৷
ফের যে ওঁরা সপরিবারে হিন্দু হলেন, সেটাও ওই জাগতিক বাসনা থেকেই৷ বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, ইত্যাদি কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন যতই ‘‘ঘরে ফেরা'' বলে এই পুনর্ধর্মান্তরকরণের প্রচারের ঢাক পেটাক, আসল ঘটনা হলো, ওঁদেরকে নাকি বিপিএল রেশনকার্ড পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল৷ কাজেই এ যদি ‘‘ঘরে ফেরা''-ই হয়, তা হলে ওঁরা ঘর ছেড়েছিলেন পেটের দায়ে, আবার ফিরেও এলেন সেই পেটের দায়েই! ওঁদের কেউ কেউ এমনও বলেছেন যে ধর্মান্তকরণের ব্যাপারটা তাঁদের কেউ বলেনইনি৷ বলা হয়েছিল, ওই অনুষ্ঠানে গেলে তাঁদের পেটপুরে খেতে দেওয়া হবে!
এবার সংসদের রাজ্যসভায় বিরোধী দলেরা, বিশেষত তৃণমূল কংগ্রেস এই ধর্মান্তরের ঘটনা নিয়ে ব্যাপক হইচই করে প্রায় রোজ অধিবেশন পণ্ড করছে৷ তাদের দাবি, খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে রাজ্যসভায় হাজির হয়ে এ নিয়ে কৈফিয়ত দিতে হবে৷ আর সরকারপক্ষ, মানে বিজেপি বলছে, তা হলে ধর্মান্তর নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটা আইন তৈরি হোক! যার অর্থ, নিজের ধর্ম বেছে নেওয়ার যে অধিকার ভারতীয় সংবিধান দেশের নাগরিকদের দিয়েছে, তা কেড়ে নেওয়া হবে!
এ নিয়ে আলোচনায় করার আগে, আরেকটি ঘটনার কথা স্মরণ করা যাক৷ ১৯৮১ সালে দক্ষিণ ভারতের মাদুরাই শহরে এক আলোড়ন ফেলে দেওয়া ধর্মান্তরকরণের ঘটনা ঘটেছিল, যেখানে দলিত সম্প্রদায়ের এক দল মানুষ মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন কেবল এই আশাতেই যে, তাঁরা দুবাইয়ে চাকরির সুযোগ পাবেন! কাজেই শুরুতেই যে কথা বলা হলো, যে ভারতে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়, তার সঙ্গে এটাও জুড়ে দেওয়া উচিত যে খেটে গরিব মানুষ প্রথমে নিজের পেটের কথা ভাবে, ধর্মের কথা ভাবে তার পরে৷ ফলে পেটের দায়েই সে এক আশ্রয় থেকে আরেক আশ্রয়ের খোঁজে যায়, কোনো আধ্যাত্মিক ভাবনার তাগিদে নয়৷
যুগ যুগ ধরে ভারতের সাধারণ মানুষ এভাবেই মুসলিম হয়েছে, খ্রিষ্টান হয়েছে৷ অনেক সময় আবার উচ্চ বর্ণের মানুষের হাতে অত্যাচারিত, শোষিত হতে হতেও এক ধরনের বিদ্রোহের রাস্তা হিসেবে তারা স্বধর্ম ত্যাগ করেছে৷ জাত-পাতের সেই অন্যায়, উচ্চবর্ণের সেই প্রভুত্ব এবং শোষণ বন্ধ করার কোনো রাস্তা না খুঁজে উল্টে গরিব মানুষের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হবে! ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো, যারা প্রায় সবাই জাতপাতের নোংরা রাজনীতিকে নিজেদের স্বার্থে জিইয়ে রেখেছে, তারা কি এটাই চায়?
সমাজবিজ্ঞানীরা, যাঁরা অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে পরিস্থিতির দিকে লক্ষ রেখেছেন, তাঁরা এ সম্পর্কে আরও কিছু জরুরি প্রশ্ন তুলেছেন৷ ধরা যাক যে নিম্নবর্ণের মানুষ একবার মুসলিম হয়ে ফের হিন্দুধর্ম গ্রহণ করলেন, হিন্দুত্ববাদীদের কথায়, ঘরে ফেরত এলেন, তাঁদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা সুরক্ষিত রাখার ভারও ওই ধর্মীয় সংগঠনগুলি নেবে তো? নাকি সেই দায় তাদের নয়?
ধরা যাক, এমনকি নিম্নশ্রেণির হিন্দুরাও তাদের ঘরে মেয়ের বিয়ে দেবে তো, বা তাদের ঘরের মেয়েকে বউ করে ঘরে তুলবে তো? সামাজিক অনুষ্ঠানে, পুজোয়-পরবে তাঁদের সাদরে ডাকা হবে তো? নাকি অপাংক্তেয় করে রাখা হবে?
তা যদি না হয়, তা হলে ‘‘ঘরে ফেরা'' আর কী করে হলো!