ধর্ষককে বিয়ে? কক্ষনো না
১৬ আগস্ট ২০১৫কেন? নষ্ট হয়ে যেত কেন? তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে? আঁচলে ‘কলঙ্কের দাগ' লেগেছে বলে? কিন্তু ধর্ষণের দায় তো ধর্ষকের হওয়া উচিত, ধর্ষিতার নয়৷ তাহলে ধর্ষণের শিকার নারীদের এ জন্য দায়ী করা হয় কেন? কেন বলা হয় ‘আপোশ'-এর কথা?
এটা কিন্তু কোনো একক ঘটনা নয়৷ সম্প্রতি শ্লীলতাহানির শিকার অপর এক নারীকে ধর্ষকের সঙ্গে ‘আপোশ' করতে বলেছিলেন মাদ্রাজ হাইকোর্টের বিচারপতি ডি. দেবদাস৷ অবশ্য বিয়ে করে ‘সব ঝামেলা' মিটিয়ে ফেলার জন্য ধর্ষককে জামিন দিয়ে বিতর্কের মুখেও পড়তে হয়েছিল তাঁকে৷ আর পড়বেন নাই বা কেন? এ রায় কি নারীবিদ্বেষী নয়? নয় পশ্চাৎমুখী? হায় রে ভারতবর্ষ, তুমি ধর্ষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কি এতটাই ক্লান্ত যে, এবার ধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষণের শিকার নারীকে মধ্যস্থতায় যেতে হবে?
আসলে একেই বলে বোধ হয় পুরুষতান্ত্রিকতা৷ তা না হলে ২০১২ সালের দিল্লি ধর্ষণকাণ্ডের জের ধরে সারা দেশে সমাজ পরিবর্তনের যে আন্দোলন হলো, তার দু'বছরেরও বেশি সময় পর এ কেমন ন্যায়বিচার! কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি কেন? এর আগেও তো ‘মহান' ভারতের এক বিচারপতি শিশু পতিতাবৃত্তিকে ধর্ষণ নয় বলে মন্তব্য করেছিলেন৷ অথবা অপর এক বিচারপতি বলেছিলেন যে, যে সব নারী বিয়ের আগে দৈহিকভাবে মিলিত হয় তারাই পরে ধর্ষণের অভিযোগ করে বা অপহরণের শিকার হয়৷
তাছাড়া আমি আজকের কথাই বা বলছি কেন? ভারতের জনমানসে তো এ ধারণাটা নতুন নয়! ধর্ষণের শিকার নারীর সম্মান বাঁচাতে ধর্ষককে বিয়ে করার উদাহরণ আমরা আগেও বহুবার পেয়েছি৷ লোকলজ্জার দোহাই দিয়ে সিনেমা-নাটক-উপন্যাস তো বটেই, বাস্তব জীবনেও ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার ঘটনা আমরা দেখেছি, শুনেছি৷ আর সেই ধর্ষণের ফলে নারী যদি সন্তানসম্ভবা হয়, তাহলে তো কথাই নেই৷ সমাজ যে তখন আঙুল তুলবে ঐ ‘জারজ' সন্তানের দিকে৷
সাম্প্রতিক ঘটনাটিও সেরকম৷ ধর্ষণের মাস খানেকের মধ্যেই ধরা পড়ে যে ধর্ষণের শিকার মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা৷ ডিএনএ পরীক্ষায় ধর্ষকের পিতৃপরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর, ধর্ষক ও তার পরিবার গর্ভপাতের জন্য মেয়েটিকে আড়াই লাখ টাকার প্রস্তাব দেয়৷ কিন্তু মেয়েটি রাজি হয়নি৷ তাই ২০০৯ সালে সাত বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয় ধর্ষক৷ এর মধ্যে বেশ কয়েক বছর পার হয়ে গেছে৷ ঘটনার শিকার মেয়েটি আজ এক সন্তানের মা৷ আর সেই নিষ্পাপ শিশুটির ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েই নাকি ধর্ষককে জামিন দিয়েছেন বিচারক৷ পুরো ঘটনাটির একটি ‘সুষ্ঠু সমাধান' করতে চেয়েছেন তিনি৷
আমার প্রশ্ন, এই ‘আপোশ', এই ‘সুষ্ঠু সমাধান', অর্থাৎ দিনের পর দিন একজন ধর্ষকের সঙ্গে বসবাস কি মেয়েটির জন্য একটা অভিশাপ, এক পরম অপমান নয়? তাছাড়া বিচারকের কাজ তো দোষীকে শাস্তি দেয়া, বৈবাহিক দ্বন্দ্ব মিটিয়ে মধ্যস্থতার কাজ ‘মিডিয়েশন সেন্টারের'৷ তাহলে? এ ধরনের একটা প্রস্তাব একটা গণতান্ত্রিক দেশের বিচারক দেন কীভাবে? তিনি কি মেয়েটিকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসা করেছিলেন? না, করেননি৷
এহেন একটা অসম্মানজনক প্রস্তাব শুনে মেয়েটির মনের অবস্থা যে কী হতে পারে – সেটা বোধহয় চাইলে সহজেই অনুমেয়৷ ধর্ষণের শিকার সেই মেয়েটি আদালতের এ রায়ে খুবই বিস্মিত হন৷ ধর্ষক লোকটা সুযোগ পেলে (স্বামী হলে তো সে সুযোগ হবেই) আবারো তাঁকে আক্রমণ করবে, এই ভয় আজও উঁকি মারে তাঁর মনে৷ তাঁর কথায়, ‘‘আমি যদি বিচারকের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেতাম, তবে আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করতাম – আপনি কি আমার যন্ত্রণা সত্যিই বোঝেন? আপনি কি জানেন বাচ্চাটাকে বড় করে তুলতে আমার কতটা কষ্ট হয়েছে?''
আপনারা হয়ত অবাক হবেন, কিন্তু ‘ধর্ষিতা' এ মেয়েটি সত্যিই তাঁর সাত বছরের শিশুটিকে মানুষের মতো মানুষ করতে চান৷ নিজে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়লেও, সন্তানকে নিয়মিত স্কুলে পাঠানোর জন্য সেলাই করা, অন্যের বাড়িতে দাসীর কাজ করতেও তিনি পিছ পা হন না৷ আর তাই, এত কষ্টের পর কোনোভাবেই ‘আপোশ' করতে চাননি তিনি৷ তাঁর কথায়, ‘‘আমি তাকে দেখতেই চাই না৷ আমাকে বাধ্য করা হলেও আমি তার কাছে যাবো না৷''
না, মেয়েটিকে আর ধর্ষকের কাছে যেতে হয়নি৷ কারণ বিতর্কিত ঐ রায় উলটে দিয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত ‘সুপ্রিম কোর্ট'৷ কিন্তু ধর্ষণের শিকার একটি মেয়ে যে ধর্ষকের সঙ্গে আপোশ রাজি হবেন না, সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? একবার যে ঝড়ের কবলে পড়েছে, সে কি আবারো সাধ করে ঝড়ের মধ্যে মাস্তুল তুলবে? না৷ তাহলে ধর্ষককে বিয়ে করে তার সঙ্গে এক বাড়িতে, একই ঘরে থাকতে, সংসার করতে কে চাইবে বলুন? সেটা যে শুধুমাত্র আপোশের, সন্ত্রাসের সংসার হবে, শান্তির, ভালোবাসার নয় – এ কথা আমাদের মাননীয় বিচারপতিরা বোঝেন না কেন? কেন বোঝেন না ধর্ষণ শুধু শারীরিকভাবে আঘাত করা নয়, মানসিকভাবে হত্যারও অপর নাম?