ধর্ষককে বাঁচাতে ব্যস্ত ভারত
১১ এপ্রিল ২০১৮ঘটনা বিজেপি-শাসিত যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশের উন্নাওয়ে৷ দেশজুড়ে ছিঃ ছিঃ রব৷ ধর্ষক বিজেপি বিধায়ক ও তার সঙ্গীরা৷ বিধায়ক ও তার শাগরেদদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনে পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছিলেন ১৮ বছরের এক তরুণী৷ থানায় লিখিত অভিযোগ জানিয়েছিলেন তরুণীর বাবা৷ এক বছরেও বিচার মেলেনি৷ উল্টে ধর্ষিতার বাবাকেই থানায় তুলে নিয়ে যায় পুলিশ৷ তারপর বেধড়ক মার৷ শেষমেশ পুলিশ হেফাজতেই মৃত্যু৷ অভিযোগ উঠেছে, পুলিশি হেফাজতে হত্যা করা হয়েছে ধর্ষিতার বাবাকে৷ পুরো ঘটনার পেছনে রয়েছে ধর্ষণে অভিযুক্ত ভারতীয় জনতা পার্টির বিধায়ক কুলদীপ সিং সেঙ্গার৷ দেদার ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিধায়ক৷ উন্নাও গণধর্ষণের ঘটনায় এখনও অভিযুক্ত বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সিং সেঙ্গারের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলেও চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত তার ভাই জয়দীপ সিং ওরফে অতুল সিংকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ৷
এর আগে রবিবার উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের আবাসন ও গৌতমপল্লী থানার সামনে নিজের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ধর্ষিতা তরুণী৷ তাঁর অবস্থা এখন স্থিতিশীল৷ এদিকে, ঘটনার সিবিআই তদন্ত চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আর্জি জানানো হয়েছে৷ আর্থিক ক্ষতিপূরণের দাবিও জানানো হয়েছে৷ বিষয়টি দিল্লির কেন্দ্রীয় মানবাধিকার কমিশন পর্যন্ত গড়িয়েছে৷
কুলদীপ সিং সেঙ্গার ধর্ষিতার কাকাকে ফোন করে হুমকিও দিয়েছে৷ প্রকাশ পেয়েছে সেই অডিও৷
‘‘গ্রামে কী করছো? মারধর করানো৷ এসব ঠিক নয়৷ আমাদের বিরুদ্ধে লিফলেট কেন ছাপিয়েছো? কে ছাপিয়েছে? যা হয়েছে, এখন পুরো বিষয়ে ইতি টানো৷ আমার কাছে এসো, আমি-তুমি মিলে নতুন অধ্যায় শুরু করি৷ উভয়ের পরিবার একসঙ্গে মিলে কাজ করবো৷ সবাইকে চুপ করাও৷ আটকাও৷ এসব করতে নিষেধ করো৷ মা-কে (নির্যাতিতার) কাল আমার কাছে আনো৷ আমি চা খাওয়াবো৷''
পুলিশও যে পুরো ঘটনা ধামাচাপা দিতে চেয়েছিল, তার প্রমাণও প্রকাশ্যে এসেছে৷ পুলিশ যে এফআইআর দায়ের করেছে, তাতে বাকি অভিযুক্তদের নাম থাকলেও বাদ দেওয়া হয়েছে বিধায়কের ভাইয়ের নাম৷ তার সহযোগী সোনু, বাউয়া, বিনিত ও শৈলুকে গ্রেপ্তার করতেই অনেক সময় ব্যয় করেছে পুলিশ৷
স্বভাবতই ফাঁপরে পড়েছেন যোগী আদিত্যনাথ৷ সরব গোটা দেশের মিডিয়া৷ পরিস্থিতি বেগতিক দেখে শেষমেশ সিট (বিশেষ তদন্তকারী দল) গঠনের আশ্বাস দিয়েছে উত্তরপ্রদেশ সরকার৷ মুখ্যমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘‘দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা৷ ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে দেখা হচ্ছে৷ লখনউ পুলিশের অতিরিক্ত মহানির্দেশকের কাছে রিপোর্ট তলব করা হয়েছে৷ দোষীরা কেউ রেহাই পাবে না৷''
ধর্ষিতা তরুণী কান্নায় ভেঙে পড়ে বলছেন, ‘‘আমাকে বিধায়ক ও তাঁর সহযোগীরা ধর্ষণ করেছে৷ গত এক বছর ধরে দরজায় দরজায় ঘুরেও সুবিচার পাইনি৷ মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গিয়েও ফল মেলেনি৷ থানায় এফআইআর দায়ের করার পর প্রাণনাশের হুমকি আসছে৷ এখন আমার দাবি, ধর্ষকদের গ্রেপ্তার করো৷ নয় তো, আমি নিজেকে হত্যা করতে বাধ্য হবো৷'' পুলিশের দিকে আঙুল উঠেছে৷ অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের পরিবর্তে ধর্ষিতার বাবাকে থানায় তুলে নিয়ে যাওয়া কেন? মারধর কেন? পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু কেন? কোনও প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারছে না পুলিশ৷ উন্নাও জেলার পুলিশ সুপার পুষ্পাঞ্জলী দেবী জানিয়েছেন, ‘‘যে চার পুলিশকর্মীর বিরুদ্ধে ধর্ষিতার বাবাকে পিটিয়ে খুনের অভিযোগ উঠছে, তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে৷''
এতসবের পরেও ভারতীয় জনতা পার্টির অভিযুক্ত বিধায়ক বুক ফুলিয়ে যোগীর কাছে গিয়ে বলে এসেছেন, কোনওমতেই তিনি পদত্যাগ করবেন না৷ তার দাবি, ওরা নিচুতলার লোক৷ সবটাই তার বিরুদ্ধে বিরোধীদের ষড়যন্ত্র৷ কেউ অভিযোগ করলেই সেটা সত্যি হয়ে যায় না৷
কী ঘটেছিল ? ধর্ষিতার অভিযোগ, ২০১৭ সালের জুন মাসে ভারতীয় জনতা পার্টির দোর্দণ্ডপ্রতাপ বিধায়ক ও তার দলবল তাঁকে ধর্ষণ করে৷ তারপর থেকে বারবার থানায় অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও পুলিশ কর্ণপাত করেনি৷ এক বছর ধরে থানাসহ এদিক-ওদিক ঘুরেও কাজ হয়নি৷ শেষমেশ অবশ্য এফআইআর নিয়েছে পুলিশ৷ কিন্তু, তারপর থেকেই হুমকি আসতে থাকে৷ অভিযোগ, গত ৩ এপ্রিল বিধায়কের ভাই এফআইআর তুলতে মেয়েটির বাবাকে জোর করে তুলে নিয়ে যায়৷ কিন্তু, কিছুতেই এফআইআর তোলেননি ধর্ষিতার বাবা৷ এরপর ৫ এপ্রিল গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকে৷ তা-ও অস্ত্র আইনে!
এই ঘটনার পর রবিবার লখনউয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের বাইরে গল্ফ ক্লাব গেটের সামনে সপরিবারে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করেন তরুণী৷ তাঁদের অভিযোগ করেন, উন্নাও জেলার বাঙ্গারমাও কেন্দ্রের বিধায়ক কুলদীপ সিং সেঙ্গার ও তাঁর জনাকয়েক সঙ্গীকে নিয়ে গত বছর জুনে তাঁকে ধর্ষণ করে৷ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে এ খবর৷ পরিস্থিতি আরও দুঃখজনক হয়ে ওঠে যখন পুলিশি হেফাজতে ধর্ষিতার বাবার মৃত্যুর খবর এসে পৌঁছায়৷ দেশজুড়ে ধিক্কার ও ছিঃ ছিঃ রব ওঠে।
এই ইস্যুতে রাজধানী দিল্লির বিধায়ক অলকা লাম্বা সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দিকে আঙুল তুলেছেন৷ তিনি বলছেন, ‘‘বলাৎকারের অভিযুক্তকে শাস্তি দেওয়ার বিষয় ছিল৷ অভিযোগ বিজেপি-র বিধায়কের বিরুদ্ধে৷ অভিযোগ করার পর ৩ এপ্রিল নির্যাতিতার বাবাকে মারধর করা হয়েছে৷ বিচার না পেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন৷ ৮ তারিখ মুখ্যমন্ত্রির নির্দেশে গোটা পরিবারকে থানায় তুলে নিয়ে যাওয়া হয়৷ অভিযুক্তের পরিবর্তে বাবাকে লকআপে ঢোকানো হয়৷ ৯ এপ্রিল পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু হয় তাঁর৷ কী হচ্ছে এই দেশে? এতকিছুর পরেও উত্তরপ্রদেশের আম জনতার রক্ত গরম হবে না? গরম না হলে তা রক্ত নয়, জল৷ আদিত্যনাথ নিজে বিয়ে করলে নারীর সম্মান কী জিনিস বুঝতেন৷ প্রধানমন্ত্রীর সন্তান থাকলে একটি তরুণীর গণধর্ষণের কষ্টটা বুঝতেন৷''
উত্তরপ্রদেশ পুলিশের মহানির্দেশক ও পি সিং জানিয়েছেন, ‘‘ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে দেখা হচ্ছে৷ ইতিমধ্যে দুই পুলিশকর্তা ও চার কনস্টেবলকে সাসপেন্ড করা হয়েছে৷'' নির্লজ্জ উত্তরপ্রদেশ পুলিশ৷ পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘‘রাতে জেল থেকে ধর্ষিতার বাবাকে উন্নাওয়ের জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল৷ চিকিৎসা চলাকালীন তাঁর মৃত্যু হয়েছে৷''
ধর্ষিতা তরুণী কিন্তু আজও বলছেন, এমন হতেই পারে না৷ তাঁর বাবাকে মারধর করা হয়েছিল৷ তা ছাড়া, তাঁদের দীর্ঘদিন ধরেই খুনের হুমকি দেওয়া হচ্ছিল৷
ইতিমধ্যেই বিরোধীদের তোপের মুখে পড়েছে যোগী সরকার৷ কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী টুইট করেন, ‘‘বিধায়কের বিরুদ্ধে তদন্তের বদলে পুলিশ তরুণীর বাবাকেই গ্রেপ্তার করছে৷ তারপর পুলিশি হেফাজতে তাঁর মৃত্যু৷ ওই বিজেপি বিধায়ক প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷''
সমাজবাদী পার্টি প্রধান অখিলেশ যাদব টুইট করেন, ‘‘এ রাজ্যে কোচিং ক্লাসে যাওয়ার সময় ছাত্রীকে গুলি করা হচ্ছে৷ বিজেপি বিধায়ক ধর্ষণ করছে৷ নেতাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ তুলে নেওয়া হচ্ছে৷''
কে এই কুলদীপ সিং সেঙ্গার?
২০০২ সালে বহুজন সমাজ পার্টির বিধায়ক নির্বাচিত হন৷ ২০০৭-এর নির্বাচনের মুখে সমাজবাদী পার্টিতে ঢুকে পড়েন৷ বঙ্গারামউ থেকে জয়ী হন৷ এরপর ২০১২ সালে ভগবন্ত নগর থেকে আবারও সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী হন৷ জয়ী হন৷ তারপর রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের ইঙ্গিত বুঝতে দেরি করেনি৷ গতবছর সমাজবাদী পার্টি ছেড়ে দিয়ে ফের ভারতীয় জনতাপার্টিতে যোগ দেন৷
সেঙ্গারের স্ত্রী সঙ্গীতা আবার জেলা পঞ্চায়েতের চেয়ারপার্সন৷ ভাই মনোজ স্থানীয় একটি পঞ্চায়েত সমিতির প্রধান৷ উত্তরপ্রদেশের উন্নাওয়ে মোট ভোটারের ২২ শতাংশ ব্রাহ্মণ৷ তারপর মুসলিম৷ তৃতীয় স্থানে রয়েছে ঠাকুর সম্প্রদায়৷ এই ঠাকুর ভোটে কব্জা রেখেছেন সেঙ্গার৷ ভোট বড় বালাই৷