নারী নির্যাতনের মোক্ষম হাতিয়ার ডাইনি নাম দেয়া
১০ নভেম্বর ২০১৪এর বিরুদ্ধে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনে অভিযোগ জানিয়ে কোনো ফল হয় না৷ কারণ এই সব হতভাগ্য নারীরা জানে না কোথায় গিয়ে কিভাবে অভিযোগ দায়ের করতে হবে, কী লিখতে হবে, কেমনভাবে লিখতে হবে৷
পুলিশও এঁদের অভিযোগকে তেমন গুরুত্ব দেয় না, অনেক সময় শোনেই না তাঁদের কথা৷ ফলে ডাইনি চিহ্নিত নারীর ওপর অত্যাচারের মাত্রা একটা অকথ্য স্তরে পৌঁছে যায়৷ সেই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে সেই নারী হয় আত্মহত্যার পথ বেছে নেন, কিংবা নিজের লোকেরাই তাঁকে পিটিয়ে মারধোর করে মেরে ফেলে৷ অত্যাচার যে কোন স্তরে পৌঁছোতে পারে – শুনলে গা শিউরে উঠবে আমাদের৷ মানুষের মলমূত্র, মুরগির রক্ত খাওয়ানো হয়, জোর করে অর্ধচেতন অবস্থায় তাঁর মুখ দিয়ে নানা রকম অসংলগ্ন কথা বলানো হয়৷ এখানেই শেষ নয়, ডাইনি চিহ্নিত নারীর স্তন কেটে নেয়া হয়, দাঁত ভেঙে ফেলা হয়৷ এই তো কিছুদিন আগে ছত্তিশগড়ে একটি উপজাতি গ্রামের পরিবারে একটি বাচ্চা অনেকদিন ধরে অসুখে ভুগছে৷ শেষে বাড়ির লোকজনের সন্দেহ নিশ্চয় কেউ তুকতাক করেছে৷ তারপর সেই বাড়িরই ৫৫ বছরের এক মহিলাকে ডাইনি নাম দিয়ে নগ্ন করে রাস্তায় এনে চোখে মুখে এবং যৌনাঙ্গে লঙ্কার গুঁড়ো ছিঁটিয়ে প্রকাশ্যে ঢিল মেরে মেরে খুন করা হয়৷
গত বছর ৫০ বছর বয়সি এক নারী এবং তাঁর মেয়েকে ডাইনি নাম দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়৷ এক এনজিও-র হিসেব মতো, ২০১০ সালে এইভাবে ডাইনি নাম দাগিয়ে দিয়ে মেরে ফেলা হয় আড়াই'শ-র মতো নারীকে৷ অতি সম্প্রতি বেশ কিছু এই ধরণের ঘটনা ঘটেছে ছত্তিশগড়, ঝাড়খন্ড, বিহার ও পশ্চিমবাংলার জলপাইগুড়ি চা-বাগান এলাকায়৷
আগেই বলেছি হয় ব্যক্তিগত না হয় পারিবারিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা৷ তবে এই ধরণের ঘটনা বেশির ভাগ হয় প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে কিংবা জনজাতি প্রধান এলাকাগুলিতে৷ কারণ ঐ সব এলাকার সামাজিক পরিবেশ, রীতি-নীতি, জীবনধারণ, দারিদ্র্য, জাতপাতপ্রথা ভিন্ন ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন৷ যেমন কারো বাড়িতে অজানা কোনো রোগে কোনো বাচ্চা মারা গেল বা কারো জমিতে ফসল হলো না বা কারোর পাতকুয়োর জল শুকিয়ে গেল তো বিহিতের কোনো উপায় না পেয়ে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে কোনো নারীর ওপর ডাইনি নাম দাগিয়ে দাও৷ তাহলে তাঁকে গ্রামছাড়া করতে সুবিধা হয়, না হয় ঢিলিয়ে কিংবা নৃশংস অত্যাচার করে মেরে ফেলো৷ সব সময় যে এটা কুসংস্কার থেকে হয়, তা নয়৷ এটা লিঙ্গ-ভিত্তিকও বটে৷ নাহলে বেছে বেছে নারীকেই কেন করা হয়৷ পুরুষদের কেন করা হয় না৷ বিধানটা যেহেতু পুরুষদেরই একচ্ছত্র অধিকার! আসলে বেশিরভাগ পুরুষদের অবচেতন মনে লুকিয়ে থাকে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার স্পৃহা৷
কোনো নারীকে কিভাবে ডাইনি নাম দেয়া হয়? পদ্ধতিটা অদ্ভুত৷ পরিবারে বা গ্রামে অজানা কারণে কোনো অঘটন বা অস্বাভাবিক কিছু ঘটলে প্রথমে ডাকা হয় ওঝা বা গুণিন নামে গ্রামের বৈদ্যকে৷ ওঝা প্রথমে কিছু শিকড় বাকড় দিয়ে ঝাড়ফুঁক করেন৷ জাদুটোনা করেন৷ তারপর একটি গাছের পাতায় কয়েকজন সন্দেহভাজন নারীর নাম লেখেন৷ যাঁর নাম আগে মুছে যাবে সেই নাকি ডাইনি৷ আরো একটা প্রক্রিয়া আছে৷ সেটা হলো কয়েকটি ছোট ছোট পুঁটলিতে চাল বেঁধে পিঁপড়ের গর্তে রাখা হয়, কয়েকজন নারীর নাম লিখে৷ পিঁপড়েরা প্রথমে যে পুঁটলির চাল খাবে, তার মধ্যে থাকা যাঁর নাম, সেই নারীকেই দাগিয়ে দেয়া হয় ডাইনি বলে৷ তৃতীয় পদ্ধতিটা আরও অদ্ভুত৷ এটা এক ধরণের নিছক ধোঁকাবাজি৷ সন্দেহভাজন নারীকে বিষাক্ত গাছ গাছড়া দিয়ে বানানো ওষুধ জোর করে খাইয়ে অসুস্থ ও তন্দ্রাচ্ছন্ন করে তাঁর মুখ দিয়ে নানা অবাস্তব, অসংলগ্ন সব কথা বলিয়ে নেয়া হয়৷ সম্প্রতি এক নারীকে নগ্ন করে রাস্তা দিয়ে হাঁটানো হয়, পরে গণধর্ষণ করা হয় তাঁর৷ এ সব ঘটনা রোধে স্থানীয় কিছু আইন থাকলেও, জাতীয়স্তরে কোনো আইন আছে বলে আমার জানা নেই৷ তবে সমাজবিজ্ঞানীদের মতো আমিও বিশ্বাস করি যে, অসুখটা সমাজের গভীরে৷ অশিক্ষাজনিত কুসংস্কার তার একটা লক্ষণ৷