নির্বাচন মধ্য গগনে, জল্পনা তৃতীয় বিকল্পের
৮ মে ২০১৯ভোটপর্ব না মিটতেই কেন্দ্রে ‘তৃতীয় বিকল্প' সরকারের সম্ভাবনা নিয়ে ফের ময়দানে নেমে পড়েছেন তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও৷ এর আগেও আঞ্চলিক দলগুলির সরকার গড়ার লক্ষ্যে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, জেডি (এস) নেতা এইচ ডি কুমারস্বামী, ওয়াই এস আর কংগ্রেস পার্টির নেতা জগন্মোহন রেড্ডি এবং ডিএমকে প্রধান এম কে স্ট্যালিনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন তিনি৷ পাঁচ দফার ভোটের পর আবার এই নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন৷ রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এবার নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টি অথবা এনডিএ কেউই ‘ম্যাজিক ফিগার' ২৭২-এ পৌঁছতে পারবে না৷ ৫ দফা ভোটগ্রহণের পর ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি ভারতীয় জনতা পার্টির৷ সেই কারণেই কংগ্রেসের সঙ্গী দলগুলোকে ভাঙিয়ে আনার চেষ্টা চালানো হচ্ছে৷
কংগ্রেস অবশ্য রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে ইউপিএ সরকার গঠনে তৎপর৷ হিসেব-নিকেশ কষে দেশের প্রতিটি কোণায় প্রচারে ব্যস্ত থাকছেন রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র৷ দলের দিল্লির নেতারা মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, সেটা পরের প্রশ্ন, প্রাথমিক লক্ষ্য বিজেপি'কে গদিচ্যুত করা৷ বলে রাখা ভালো, রাহুল গান্ধী আগেই স্পষ্ট করেছেন, ইউপিএ সরকার হলে বহুজন সমাজ পার্টির নেত্রী মায়াবতী অথবা তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে তাঁর আপত্তি নেই৷ সমাজবাদী পার্টি প্রধান অখিলেশ যাদব তো বলেই দিয়েছেন, ‘‘এবার দেশে মহিলা প্রধানমন্ত্রী দেখতে চাই৷''
এতসবের মধ্যে ৭ দফা ভোটের আরো দুটি পর্ব বাকি৷ বছর দুয়েক আগের উদ্যোগ নতুন করে শুরু হয়েছে৷ কেন্দ্রে অ-বিজেপি, অ-কংগ্রেসি সরকার গড়তে আঞ্চলিক দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা-নেত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে৷ কেরলের সিপিএম মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে৷ আগামী ১৩ মে ডিএমকে প্রধান এম কে ষ্ট্যালিনের সঙ্গেও বৈঠকের সূচি নির্ধারিত হয়েছে৷ টলিফোনে কথা হলো কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী এইচ ডি কুমারস্বামীর সঙ্গে৷ যদিও কুমারস্বামীর দপ্তর জানিয়েছে, ‘‘কেসিআর সৌজন্যমূলক কথা বলেছেন৷'' শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, ষ্ট্যালিন কেসিআরের সঙ্গে বৈঠকে রাজি হননি৷ তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়ে নির্বাচন লড়ছেন৷ রাহুল গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী দেখতে চান বলেও মন্তব্য করেছেন৷
এদিকে, কেসিআরের এই উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই রাজনৈতিক মহলে৷ ঘোরতর কংগ্রেসবিরোধী নেতা তিনি৷ তাছাড়া এর আগে একাধিক ইস্যুতে বিজেপি'র পাশে দাঁড়াতে দেখা গেছে তাঁকে৷ মোদী সরকারের নোট বাতিল, জিএসটিকে সমর্থন করেছিলেন তিনি৷ নির্বাচন প্রক্রিয়া চলাকালীন টিআরএস প্রধান যেভাবে আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন, তাকে মোটেই ভালো চোখে দেখছে না সিপিএম৷ দলের নেতা মোহাম্মদ সেলিম ডয়েচে ভেলেকে জানালেন,‘‘এই উদ্যোগ নতুন নয়৷ বিজেপি'র ‘প্ল্যান-বি' হিসেবে বিরোধী ঐক্য ভাঙার নামে কেউ কেউ ময়দানে নামেন৷ মমতা ব্যানার্জি, কেসিআর, শিবসেনার নেতারা এই চেষ্টা চালিয়েছেন৷ বিজেপি বা এনডিএ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছে না৷ তাই প্ল্যান-বি হিসেবে কেসিআরকে নামানো হয়েছে৷ কেসিআর কখনোই বিজেপির বিরুদ্ধে সরব হননি৷ তিনি এমন একটা ব্যবস্থাপনার মধ্যে আছেন, যেখানে উনি তেলেঙ্গানায় থাকবেন, কেন্দ্রে বিজেপি সরকার থাকবে৷ উনি ঘোলা জলে মাছ ধরার জন্য নেমেছেন৷ অতীতে বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলোর জোটবদ্ধ হয়ে সরকার গড়ার অনেক উদাহরণ আছে৷ ‘৮৯, '৯৬, '৯৮, ২০০৪ সালে বিরোধীরা সরকার গড়েছে৷ আলোচনায় আপত্তি নেই, তবে আরো দু-দফার ভোট মিটে যাওয়ার পর এই উদ্যোগ নিলে ভালো হয়৷''
তবে দিল্লিতে টিআরএসের এক নেতা জানিয়েছেন, ‘‘এখনো পর্যন্ত যা ইঙ্গিত মিলেছে, তাতে ২৩ মে-র পর কেন্দ্রে এনডিএ বা ইউপিএ কোনো পক্ষই সরকার গড়ার মতো সংখ্যা নিয়ে আসতে পারবে না৷ এই পরিস্থিতিতে একমাত্র বিকল্প হতে পারে আঞ্চলিক দলগুলির তৃতীয় ফ্রন্ট৷'' তাঁর ব্যাখ্যা, উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ যাদব, মায়াবতী, পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জি, ওড়িশায় নবীন পট্টনায়ক, অন্ধ্রপ্রদেশে জগন্মোহন রেড্ডি, তেলেঙ্গানায় চন্দ্রশেখর রাও, তামিলনাড়ুতে এম কে স্ট্যালিনের দল ১৫০ থেকে ১৮০টি আসন পেতে পারে৷ সরকার গড়ার উদ্যোগ নিলে আরো দল যোগ দেবে ফ্রন্টে৷
পিনারাই বিজয়নের ঘনিষ্ঠরা অবশ্য বলেছেন, ‘‘নির্বাচনি প্রচারের ক্লান্তি কাটাতে দু-দিনের জন্য কেরলে এসেছেন কেসিআর৷ মন্দির দর্শন করবেন৷ মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেও সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ হয়েছে৷'' ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা রাম মাধব বলেছেন, ‘‘তৃতীয় ফ্রন্ট দিবাস্বপ্ন৷ বিজেপি এবার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও দিল্লিতে আরো একবার এনডিএ সরকার আসছে৷''
রাজনৈতিক বিশ্লেষক দীপ্তেন্দ্র রায়চৌধুরি ডয়চে ভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘‘কংগ্রেসের সঙ্গে রয়েছে, এমন দলগুলোকে নির্বাচনের ফল ঘোষণার আগে কংগ্রেসের গন্ডি থেকে বের করে আনতেই রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ‘তৃতীয় ফ্রন্ট'-এর তত্ত্ব তুলে ধরা হচ্ছে৷ এইচ ডি দেবগৌড়ার জেডি (এস), ষ্ট্যালিনের ডিএমকে দলগুলো ওতপ্রোতভাবে কংগ্রেসের সঙ্গে জোটবদ্ধ৷ কেসিআর তাদের সরিয়ে আনতে চাইছে৷ এতে লাভবান হবে বিজেপি৷ প্রচ্ছন্নভাবে বিজেপিকে সাহায্য করা হচ্ছে৷ বিগত শতকে বামেরা এই উদ্যোগ নিয়েছিল, কিন্তু তা সফল হয়নি৷ কেসিআরের ফর্মুলার বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব৷ পুরোটাই ভ্রান্ত ধারণা৷''
গতবছর দেশের উত্তর ও পূর্বের রাজ্যগুলিতে ঘুরে এসেছেন৷ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ওডিশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েকের সঙ্গে বৈঠক করেছেন৷ দিল্লিতে পৌঁছে মায়াবতী ও অখিলেশের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েও পারেননি তিনি৷ সেই সময় মমতা ও নবীনের সঙ্গে বৈঠকও তেমন ফলপ্রসূ হয়নি৷ সম্প্রতি মমতা ব্যানার্জি এক সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘‘আলোচনার জন্য ফের বাংলায় আসতে পারেন কেসিআর৷'' তৃণমূল নেতা ডেরেক ও'ব্রায়েন বলেছেন, ‘‘বিজেপি'র এক্সপায়ারি তারিখ আসন্ন৷ পরিস্থিতি বুঝে ফেডারেল ফ্রন্টের আলোচনা শুরু হয়েছে৷ রাজনীতিতে সবসময় আলোচনাকে স্বাগত জানাতে হয়৷''
যদিও কংগ্রেস কেসিআরের ‘তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতিকে বিজেপি'র ‘বি টিম' বলে কটাক্ষ করছে৷ দলের অভিযোগ, বিজেপিকে সাহায্য করতেই তৃতীয় ফ্রন্ট গড়ার কথা বলা হচ্ছে৷ দলের বাংলার নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘সবটাই বিজেপির চক্রান্ত৷ এর আগেও ওরা এমন ষড়যন্ত্র করেছে৷ আগামী ২৩ মে মোদী সরকারের পতন নিশ্চিত জেনে গোপন বোঝাপড়া করে তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী পুরোনো প্রস্তাব নিয়ে মাঠে নেমেছেন৷ কিন্তু উনি ব্যর্থ হবেন৷ কারণ, সবাই জেনে গেছে, তৃতীয় ফ্রন্ট বা ফেডারেল ফ্রন্টের লুকোনো সত্যিটা হলো, কেন্দ্রে আরো একবার মোদী সরকার ফিরিয়ে আনা৷''