নেদারল্যান্ডসের কাছে হারের লজ্জা বাংলাদেশের
২৮ অক্টোবর ২০২৩আহহহ! আক্ষেপ বা হতাশা যাই বলুন…..অনুভূতি প্রকাশের বাংলা এই শব্দটি বাংলাদেশ ক্রিকেটের অপর নাম হতে পারে৷ বিশাল স্বপ্নের এই বিশ্বকাপে শেষ পর্যন্ত ওই ‘আহহহ' সবেধন নীলমনি হতে যাচ্ছে৷
পাহাড়সমান লজ্জা মাথায় নিয়ে নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে এই হারে এর বাইরে আর কিছু নেই হতাশা প্রকাশের যোগ্য অভিব্যক্তিতে৷ ডাচদের সঙ্গে এর আগে দুবার ওয়ানডেতে জিতেছিল বাংলাদেশ৷ তৃতীয়বার হার জুটল৷ গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খুব কাছেও গিয়েও জিততে ব্যর্থ হয়েছিল ডাচরা৷ সেই প্রতিশোধ যেন নিল এবার৷
যে ম্যাচটি নিয়ে বিশ্বকাপের আগে থেকেই জয়ের চিন্তা ছিল, সেই ম্যাচেই কি লেজে গোবড়ে ব্যাপার! নেদারল্যান্ডসকে জয়ের পুঁজি এনে দেয়া ৬৮ রান করা অধিনায়ক স্কট এডওয়ার্ডস দুবার জীবন পান ০ রানে৷
লিটন-সাকিব-মুশফিকরা বড় নাম হয়েও হতাশার সমার্থক থেকে যান ওই ব্যাটিং ব্যর্থতার গেরোয়৷ এর যেন শেষ নেই৷ ভুলের দিনে ক্ষীণ আশা দিতে থাকা মাহমুদউল্লাহ-শেখ মেহেদীর ৩৮ রানের জুটিও থামে ওই ভুলে-ই৷ ওই রান আউটটি না হলে কিছু কি হতে পারত! এই আশা তো সবসময়ের৷ এমন আশা-নিরাশার দোলাচলেই বাংলাদেশ ক্রিকেট হেঁটেছে সবসময় ‘আহহহ' আক্ষেপ নিয়েই৷ তাই আবারও ভুলের পর আক্ষেপ৷ নিজের ভুল কলে ১৭ রান করা মেহেদী অহেতুক রান আউট হলেন৷ বাংলাদেশের জয়ের শেষ স্বপ্নটাও সেখানে শেষ হয়৷ এরপর মাহমুদউল্লাহ ফিরলেন ২০ রানে তিন ওভার পর৷
তাই নিজেদের সেরা ফরম্যাটে প্রথম বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল খেলার স্বপ্ন ওই স্বপ্নই থেকে যায়৷ কলকাতায় মিরপুরের আবহ তুলেও সমর্থকেরা ক্রিকেটারদের জাগাতে ব্যর্থ হয়৷ চেনা পরিবেশ বা পরিচিত কন্ডিশনের মাঠও এদিন সাকিব-মুশফিকদের নয়, তাদেরই ভুলে হাত বাড়িয়ে দেয় নেদারল্যান্ডসকে৷ তাই মিরপুরে খেলে ব্যাটিং-বোলিংয়ের যে পরিকল্পনা সাকিবদের মুখস্থ সেই পরিকল্পনায় তাদেরই বধ করে ডাচরা৷ কমলারা বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবুজ দেয়ালে এঁকে দিয়ে যায় বেদনার নীল রং৷
এ ম্যাচের আগে তাসকিনরা বলেছিলেন শেষ চারটি ম্যাচ জিততেও পারেন৷ এই হারের পর বাকি তিন ম্যাচ নিয়ে কি একই স্বপ্ন দেখবেন?
ব্যাটিং ব্যার্থতা বাংলাদেশের পুরোনো রোগ৷ এ নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই৷ এই ব্যর্থতাতে প্রতি বড় ইভেন্টে হৃদয়ে হাহাকার জায়গা নেয়৷ খেলা সরে গিয়ে নানা বিষয়ে সরব হয়ে ওঠে বাংলাদেশের ক্রিকেট৷ নানা সিরিজেও এই ব্যাটিং ব্যর্থতাই থাকে হতাশার মূল কারণ৷
অতীত নিয়ম মেনে এবারও সেই চিত্র ফিরে এলো৷ আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ বাদে আর একটি ম্যাচেও বাংলাদেশ ব্যাটাররা নিজেদের সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে পারেনি৷ তাই ক্রিকেটের বাইরের চিত্র হয়ে ওঠে বড়৷ এই হতাশা কাঁধে নিয়ে বিশ্বকাপ চলাকালীন দলের অধিনায়ক সাকিব চলে আসেন দেশে৷ তিনদিনের একান্ত অনুশীলন করেন শৈশবের গুরু নাজমুল আবেদিন ফাহিমের কাছে৷ এ নিয়েও পক্ষে-বিপক্ষে মত রয়েছে৷ ভাল খারাপ যুক্তি-তর্ক আপাতত তুলে রাখা যাক, কাজের কাজটা কি কিছু হয়েছে?
উত্তরটা খুব সোজা, একদমই না৷ তাই সাকিবকে দিয়েই নেদারল্যান্ডস ম্যাচে বাংলাদেশ ইনিংস শুরু করা যাক৷ সাকিব সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে যেভাবে আউট হয়েছেন প্রায় সেই ভঙ্গিতেই আউট হলেন৷ বাড়তি বাউন্সে মানিয়ে নিতে না পেরে৷ মিরপুরের ইনডোরে দুই দিনে তিন ঘন্টার একক চেষ্টায়ও নিজের দুর্বলতা কাটাতে পারেননি৷ তাকে নিয়ে সঠিক পরিকল্পনায় ঠিক জায়গায় ডেলেভারি করে সফলতা পল ফন মিকেরেন৷
১৪ বলে মাত্র ৫ করে ফেরেন তিনি, দল তখন ১৬ ওভারে ৬৩ রানে ৪ উইকেট৷ অথচ এই সাকিব প্রতিপক্ষ অধিনায়ককেই অনুসরণ করতে পারতেন৷ কলকাতার এই উইকেটে ব্যাট করা কঠিন ছিল৷ কিন্তু সেট হওয়া কঠিন না৷ এডওয়ার্ডস সময় নিয়ে উইকেটে থেকেছেন৷ স্ট্যাম্প টু স্ট্যাম্প বল করা সাকিবের ওভারে ডট দিয়েছেন৷ সাইব্র্যান্ড এঙ্গেলব্রেখট সাকিবের বল খেলতেই পারছিলেন না৷ তবুও ডট এর পর ডট দিয়েছেন, জুটি গড়েছেন মূল্যবান ৭৮ রানের৷ অথচ সাকিব টিকতেই পারলেন না৷ তার সঙ্গে উইকেটে পড়ে থেকে সঙ্গ দেয়ার মতোও কেউ তাই দাঁড়ালেন না৷
২৩০ রানের লক্ষ্যে নেমে সাকিবের আগেই ভুল পথে চলতে শুরু করে বাংলাদেশ৷ লিটন দাস ধীর ও নিচু উইকেটে সোজা ব্যাটে না খেলে রিভার্স সুইপ করতে চাইলেন৷ যা লিটন সাধারণত করেন না৷ সেই ভুলে আরিয়ান দত্তকে উইকেট বিলিয়ে দিলেন৷ ১২ বলে ৩ রানে থাকা লিটনের গ্লাভসে লেগে বল উপরে উঠে যায়৷ বল লুফে নিয়ে ক্যাচ আউট করেন এডওয়ার্ডস৷ তিন চারে শুরু করা তরুণ তানজিদ তামিম আরও একবার শুরুর ঝলক ছাড়া কিছু দেখাতে পারলেন না৷ ১৬ বলে ১৫ রানে লোগান ফন বিকের বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন৷ এখন পর্যন্ত ভারত ম্যাচে ভাল ব্যাট করা বাদে এই তরুণের ঝুলিতে কিছু নেই৷
ডাচদের মতো শুরুতে জোড়া উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশও কিছু রানের পিছু ছুটছিল৷ মিরাজ পাল্টা আক্রমণ করেন আরিয়ানের এক ওভারে ১৪ রান নিয়ে৷ কিন্তু বাংলাদেশের মতো দারুণ বোলিং পরিকল্পনা করে দুই ওভার পরেই উইকেট আদায় করে নেয় ডাচরা৷
বিশ্বকাপে রং হারানো শান্ত আরও একবার বিবর্ণ৷ পল ফন মিকারেনকে দারুন পুলে এক চার মারার পর ১৮ বলে ৯ রানে স্লিপে আউট হন৷ থামে ২৬ রানের ছোট জুটি৷
চতুর্থ উইকেটে সাকিব-মিরাজ জুটি ভরসার জায়গা ছিল৷ কিন্তু সাকিবের আগের ম্যাচের মতো একই রকম আউটে ১৮ রানের বেশি এগোয়নি জুটিটি৷ সাকিব বিদায়ের পরের ওভারেই ফেরেন মিরাজ৷ ৪০ বলে ৫ চার ও ১ ছক্কায় ৩৫ রান করে ওই সময় পর্যন্ত সাহস দিচ্ছিলেন এই ব্যাটার৷ অথচ বাস ডি লিডির বলে মিরাজও উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন৷
৬৯ রানে ৫ উইকেট হারানো বাংলাদেশের জন্য তখন ২৩০ রান অনেক দূরের মনে হচ্ছিল৷ তা সত্যি করে দেন মুশফিক আউট হয়ে৷ মোস্তাফিজের অফকাটারে বরাবরই পরাস্ত হন বিপক্ষের ব্যাটারা এবার মিকেরেনের অফকাটারে সরাসরি বোল্ড মুশফিক৷ ৫ বলে ১ রান করা এই আসরে বাংলাদেশের নিয়মিত পারফরমারের ব্যাট-প্যাড ফাঁকি দিতে সফল হন মিকেরেন৷ মুশফিকের বিদায়ের পর মাহমুদউল্লাহকে সঙ্গ দেয়ার মতো প্রতিষ্ঠিত ব্যাটার তো ছিলেন না আর৷ সেরা ব্যাটারদের ব্যর্থতার দিনে লেজের ব্যাটারদের কি দোষ দেয়া যায়!
অথচ নেদারল্যান্ডসকে বেঁধে রাখা গিয়েছিল নাগালের মাঝেই৷ পিচের সুবিধা কাজে লাগিয়ে স্পিন বিষে নীল করে কমলাদের৷ সঙ্গে পেসাররাও যোগ দেন বুদ্ধিদীপ্ত বোলিংয়ে তাই অবশ্য ওই রানও হতো না দলটির৷ জোড়ায়-জোড়ায় উইকেট হারিয়ে ইনিংসে ধুঁকেছে তারা৷ ইনিংসের শুরুতে ৬৩ রানে ও ১৮৫ রানে দুটি করে উইকেট হারিয়ে স্বল্পপুঁজিতেই সন্তুষ্ট হতে হয় ডাচদের৷ ১০৭ রানে ৫ উইকেট হারানোর পর লড়াকু পুঁজি আসার কৃতিত্ব অধিনায়ক স্কট এডওয়ার্ডস ও সাইব্র্যান্ড এঙ্গেলব্রেখটের৷ তাদের সময়োপযোগী জুটিটা দারুণ কাজে দেয়৷ এডওয়ার্ডস এই বিশ্বকাপে নিজের দ্বিতীয় ও ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ১৪তম ফিফটি তুলে ৮৯ বলে ৬ চারে ৬৮ রানে ফেরেন মোস্তাফিজুরের কাটারে মিরাজের ক্যাচ হয়ে৷ প্রায় ১৫ ওভার ক্রিজে থেকে ৭৮ রানের জুটি ভাঙ্গে ডাচদের৷ সঙ্গী ফেরার ঠিক পরের ওভারেই ফিরতে হয় সাইব্র্যান্ডকেও৷ মাহেদি হাসানের বলে লেগ বিফোর হয়ে ৬১ বলে ৩ চারে ৩৫ রানে তার লড়াই থামে৷
এ দুজনের ব্যাটে দুইশোর কাছাকাছি চলে যায় ডাচরা৷ তবে ইনিংসের হাইলাইটস ছিল শেষ তিন ওভার৷ পুরো সময়ে তারা ওই তিন ওভারেই ১০ এর ওপর রান নিতে সফল হয়৷ শেখ মেহেদির শেষ ওভারটিতে ১৭ রান নিয়েছেন লোগান ফন বিক৷ ১৬ বলে ১ ছক্কা ও দুই চারে ২৩ রান তার৷ এর আগে ইনিংসের শুরুতে দুই ওপেনার বিক্রমজিৎ সিং ৩ ও ম্যাক্স ও‘ডাউড ০ রানে ফিরলে বিপদে পড়ে নেদারল্যান্ডস৷ ওই অবস্থা থেকে কিছুটা লড়াই করেন ২০১১ বিশ্বকাপেও কলকাতায় খেলে যাওয়া ওয়েসলি বারেসি৷ ১৫ রান করা কলিন আকারম্যানকে নিয়ে ৫৯ রানের দারুণ জুটিও গড়েন ১১ ওভারের মতো খেলে৷ অথচ ওই সময়ে ৬৩ রানে জোড়া ধাক্কায় ফিরে যান এ দুজনও৷ ইনিংসের শেষদিকে ১৮৫ রানে এডওয়ার্ডস ও সাইব্র্যান্ড ফেরেন৷ তবে তাদের ৭৮ রানের জুটি ও শেষ তিন ওভারের ৩৬ ডাচদের ভালো অবস্থায় নিয়ে যায়৷
ডাচ ম্যাচের পর ওয়ানডে সুপার লিগের কোনো কিছু কি মনে পড়বে কারও! পড়তেও পারে৷ কি দারুণ ভারসাম্যপূর্ণ একটি দল খোলনাচলে খেই হারাল বিশ্বকাপের ঠিক আগে৷ নানা কান্ডে হযরবল হয়ে শেষ হল সব৷ অবশ্য আক্ষেপের কিছু তো নেই, বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান পাপনের ভাষ্যমতে বাংলাদেশ সবসময় পরের টুর্নামেন্টে নজর দেয়৷ তাই ২০২৩ বিশ্বকাপের স্বপ্নযাত্রাটা আজই শেষ করা যাক৷
সংক্ষিপ্ত স্কোর :
নেদারল্যান্ডস: ৫০ ওভারে ২২৯ (এডওয়ার্ডস ৬৮, বারেসি ৪১, সাইব্র্যান্ড ৩৫; তাসকিন ২/৪৩, সাকিব ১/৩৭, মোস্তাফিজ ২/৩৬)
বাংলাদেশ: ৪২.২ ওভারে ১৪২ (মিরাজ ৩৫, মাহমুদউল্লাহ ২০, শেখ মেহেদী ১৭; মিকেরেন ৪/২৩, ডি লিডি ২/২৫)
ফল: নেদারল্যান্ডস ৮৭ রানে জয়ী
ম্যাচ সেরা: পল ফন মিকেরেন