অভিজিৎ আর এসথারের গবেষণায় বাংলাদেশ
১৬ অক্টোবর ২০১৯এই গবেষণার জন্য যেসব মডেল তাঁরা অনুসরণ করেছেন তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ব্র্যাকের উদ্ভাবিত ‘আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন’ কর্মসূচি৷ দারিদ্র্য দূরীকরণে সাফল্যের কারণে যা এখন ৪০ টি দেশে প্রয়োগ করা হচ্ছে৷
২০০২ সালে দারিদ্র্য দূরীকরণে বাংলাদেশে একটি প্রকল্প হাতে নেয় ব্র্যাক৷ উদ্দেশ্য অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর টেকসই উন্নয়ন৷ ক্ষুদ্র ঋণসহ দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রচলিত যেসব প্রকল্প ছিল এটি তার চেয়ে আলাদা৷ ঋণ বা অর্থ সহায়তা দিয়েই এখানে দায়িত্ব শেষ হয় না৷ তার বদলে প্রয়োজনের ভিত্তিতে অতিদরিদ্রদের গবাদিপশু, হাঁস-মুরগী, নৌকার মতো বিভিন্ন সম্পদ দেয়া হয়, যা দিয়ে তারা উপার্জন করতে পারেন৷ থাকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, নিশ্চিত করা হয় স্বাস্থ্যসেবাও৷ পাশাপাশি ব্র্যাকের কর্মীরা নিয়মিত মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শন করেন যাতে কেউ কোনো সমস্যায় না পড়ে৷ পরবর্তীতে মূল্যায়ন পরীক্ষায় দারিদ্র্য দূরীকরণে এই প্রকল্পটির সাফল্য প্রমাণিত হয়৷
ব্র্যাকের উদ্ভাবিত মডেলটি কি বাংলাদেশের বাইরেও দারিদ্র্য দূরীকরণে কাজে লাগবে? চিকিৎসাশাস্ত্রে বহুলব্যবহৃত ‘র্যান্ডমাইজ়ড কন্ট্রোল ট্রায়াল’ এর মাধ্যমে সেটিই পরীক্ষা করতে চেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি-এমআইটির অভিজিৎ ব্যানার্জি আর এসথার ডুফলো৷ এজন্য ব্র্যাকের অনুসরণে ছয়টি দেশের স্থানীয় এনজিওগুলোর মাধ্যমে পরিচালিত একই ধরণের প্রকল্প বেছে নেন তারা৷ তাদের সহযোগিতা দেয় এমআইটির আব্দুল লতিফ জামিল পভার্টি অ্যাকশন ল্যাব এবং ইনোভেশনস ফর পভার্টি অ্যাকশন নামের একটি অলাভজনক সংস্থা৷ গবেষণাটি প্রকাশ হয় ২০১৫ সালে৷ পরবর্তীতে এ নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয় গবেষণাধর্মী জার্নাল ন্যাচার ও ইকোনমিস্টে৷
প্রতিবেদনগুলো অনুযায়ী, অভিজিৎ ও তাঁর সহকর্মীরা গবেষণার জন্য দুইটি দল বেছে নেন, একটি প্রকল্পের অধীনে থাকা পরিবারগুলো অন্যটি এই সুবিধার বাইরে থাকা অতিদরিদ্ররা৷ দুইবছর পর তারা পরীক্ষা করে দেখেন দুই দলের মধ্যে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়েছে কীনা৷ ফলাফলে দেখা যায় কর্মসূচীতে অংশগ্রহণকারীদের খাদ্য গ্রহণের পরিমান পাঁচ ভাগ বেড়েছে, বেড়েছে আয়ের পরিমানও৷ সেইসাথে তাদেরকে যেসব সম্পদ দেয়া হয়েছিল তার মূল্যও ১৫ ভাগ বেড়েছে৷ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এই কর্মসূচী শেষ হওয়ার এক বছর পর খোঁজ নিয়েও তাদের স্বচ্ছল জীবন যাপনের চিত্র পেয়েছেন তারা৷ ছয়টি দেশের ১০ হাজার দরিদ্র পরিবারের উপর গবেষণাটি চালানো হয়েছিল সাত বছর ধরে৷
অভিজিৎদের গবেষণায় ব্র্যাকের মডেলের ভূমিকা
সব মিলিয়ে গত ১৬ বছর ধরে অতিদরিদ্র দূরীকরণ নিয়ে গবেষণা করে আসছেন অভিজিৎ, এসথার ডুফলো ও সেনথিল মুলাইনাথান৷ সেখান থেকে উঠে এসেছে বেশ কিছু যুগান্তকারী চিন্তাধারা, যার সাম্প্রতিকতম ফল ২০১৯ সালে প্রকাশিত অভিজিৎ ও এসথারের ‘হোয়াট দ্য ইকোনোমি নিডস নাও’ শীর্ষক বইটি৷ নোবেল কমিটি তাদের ঘোষণায় বলেছে, গোটা বিশ্বে দারিদ্র্য দূরীকরণে তাঁরা সবার জন্য গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান হাজির করেছেন৷ সেই সঙ্গে তাদের অভিজ্ঞতা ভিত্তিক গবেষণা পদ্ধতিটি উন্নয়ন অর্থনীতিতেও নতুন এক ধারার জন্ম দিয়েছে৷
২০১১ সালে তাঁরা ‘পুওর ইকোনমিক্স' বইটি প্রকাশ করেন, যা ‘গোল্ডম্যান স্যাকস বিজনেস বুক অফ দ্য ইয়ার' পুরস্কার পায়৷ তবে অভিজিৎ এবং তাঁর সহকর্মীদের কাজ সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে ২০১৫ সালে ব্র্যাকের উদ্ভাবিত মডেল নিয়ে গবেষণাটি প্রকাশের পরে৷
ব্র্যাকের আলট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামের প্রধান রোজিনা হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অভিজিৎ ও তাঁর সহযোগী গবেষকবৃন্দের দারিদ্র্য বিষয়ক গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ব্র্যাকের আলট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন মডেলটি৷ তাছাড়া বিভিন্ন দেশের স্থানীয় পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে সেখানকার চরম দরিদ্র মানুষের অবস্থা পরিবর্তনে কীভাবে কাজে লাগানো সম্ভব সে বিষয়ে তাঁদের গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়েছে৷’’
রোজিনা জানান, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ৪৭টি জেলায় ২০ লাখের বেশি পরিবার তাদের এই কর্মসূচির সুফল পেয়েছে৷ এর কার্যকারিতা প্রমাণ হওয়ায় ৪০ টিরও বেশি দেশে এই মডেলটি স্থানীয় বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে৷ বিভিন্ন দেশে এসব প্রকল্পের কিছু ব্র্যাক নিজে বাস্তবায়ন করছে, বাকিগুলো করছে সেসব দেশের সরকার অথবা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা৷