পথের পাঁচালিতেই শেষ!
৫ নভেম্বর ২০১৮আন্তর্জাতিক সিনেমার নির্বাচনে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন, বা বিবিসি-ই যে শেষ কথা, এমন কথা কেউ বলে না৷ তা-ও তারা যখন বিশ্বের ৪৩টি দেশের মোট ২০৯ জন চলচ্চিত্র সমালোচককে দায়িত্ব দেয় তাঁদের পছন্দসই ছবির তালিকা তৈরি করতে এবং তার ভিত্তিতেই তৈরি হয় সর্বকালের সেরা ১০০ বিদেশি ছবির তালিকা, তখন মানতেই হয় যে, এক ধরনের গণতান্ত্রিক এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি মেনে চলার চেষ্টা হয়েছে৷ সেই সেরা ১০০ তালিকায় প্রত্যাশিতভাবেই সবচেয়ে বেশি জায়গা পেয়েছে ফরাসি সিনেমা৷ মোট ২৭টি সিনেমা৷ ভাষার হিসেবে তার পরেই আছে ১২টি চীনা সিনেমা, ম্যান্ডারিন ভাষায়৷ এরপর ইতালীয় এবং জাপানি ভাষার ১১টি করে সিনেমা৷ চীনা এবং জাপানি সিনেমার এই স্বীকৃতি বুঝিয়ে দিয়েছে, তথাকথিত ‘ওরিয়েন্টাল' সিনেমা এক পশ্চিমী সংবাদ মাধ্যমের তৈরি এই তালিকায় প্রাপ্য গুরুত্ব পেয়েছে৷ অবশ্য যেখানে আকিরা কুরোশাওয়ার মতো চিত্র পরিচালক আছেন, সেখানে প্রাচ্যের সিনেমাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগও ছিল না৷
কিন্তু বিস্ময়টা অন্য জায়গায়৷ এই ১০০ ছবির তালিকায় একটিমাত্র ভারতীয় ছবি৷ সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালি'৷। ভারতে হিন্দি, তামিল, তেলুগু মিলিয়ে যেখানে বেশ কয়েক হাজার কোটি টাকার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি, বছরভর এত ছবি তৈরি হয়, সেখানে ৬০ বছর আগে তৈরি একটি বাংলা ছবির পর আর কিছুই নজরে পড়ল না! সত্যজিৎ রায় ছাড়াও যে দেশে ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, আদুর গোপালকৃষ্ণণ, গোবিন্দ নিহালনি, শ্যাম বেনেগাল, এস এস সথ্যুর মতো দিকপাল এবং আন্তর্জাতিক স্তরে খ্যাতিসম্পন্ন, পুরস্কৃত এবং আদৃত পরিচালকরা আছেন, সেখানে আর একটি ছবিও স্বীকৃত হলো না? তা হলে কি ধরে নিতে হয়, পথের পাঁচালির পর আর এমন কোনো ভারতীয় ছবি তৈরি হয়নি, যা বিশ্বমানসে ছাপ ফেলতে পেরেছে?
বিবিসি যে ২০৯ চলচ্চিত্র সমালোচককে তাঁদের পছন্দের ছবির তালিকা তৈরি করতে বলেছিল, তাঁদের মধ্যে একজন কলকাতার বর্ষীয়ান চিত্র-সাংবাদিক সোমা এ চ্যাটার্জি৷ ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে তাঁর কাছে প্রথমেই জানতে চাওয়া হয়েছিল, এই তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে কি কোনো শর্ত আরোপ করে দেওয়া হয়েছিল? এমন কোনো বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছিল, যা না থাকলে কোনো ছবি নির্বাচনের যোগ্য বিবেচিত হবে না? না, এমন কোনো শর্ত ছিল না৷ শুধু বলে দেওয়া হয়েছিল, ইংরেজি ভাষী দেশের ছবিকে তালিকার বাইরে রাখতে হবে৷ ইংরেজির বাইরে যে কোনো ভাষার ছবি হতে হবে৷ ব্যাস, ওইটুকুই৷ বললেন সোমা চ্যাটার্জি৷ প্রত্যেককে ১০টা করে ছবির তালিকা দিতে বলা হয়েছিল৷ সোমা চ্যাটার্জির তালিকায় একমাত্র ভারতীয় ছবি ছিল, সেটাও সত্যজিৎ রায়েরই ‘অপুর সংসার'৷ অর্থাৎ বিখ্যাত অপু ট্রিলজির তৃতীয় ছবিটি৷ এই ছবিটি আরো কয়েকজন সমালোচকের তালিকাতে ছিল৷
কিন্তু সত্যজিতের মতোই আরেক বিখ্যাত পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের কোনো ছবি কেন কারো তালিকাতেই জায়গা পায়নি? ঋত্বিক কি সেভাবে ছুঁতে পারেননি আন্তর্জাতিক দর্শককে? এই প্রশ্নের জবাবে সোমা চ্যাটার্জি বললেন, ‘‘ছুঁতে পেরেছেন, কিন্তু সেটা অত ব্যাপক বোধহয় হয়নি বলে আমার মনে হয়৷ যতটা ব্যাপক সত্যজিৎবাবু হয়েছেন৷ মৃণাল সেনের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা হয়েছে৷ আমার মনে হয়, আরো জনপ্রিয়তা প্রয়োজন ছিল৷ বা বলা ভালো, আরো বেশি বিপণন দরকার ছিল, যেটা ওঁর (ঋত্বিকের) নেই৷ ওঁর ছবিগুলো দেখানো হয়েছে বহু পরে৷'' আরো একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন সোমা চ্যাটার্জি যে, যেসব আন্তর্জাতিক দর্শকরা একসময় সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্বিকদের ছবি দেখে উদ্বেলিত হয়েছেন, তাঁদের সংখ্যাটা এখন কমে এসেছে৷ এখন অনেকেই ওঁদের ছবি দেখেননি৷ ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই ওঁদের প্রভাব কমে এসেছে৷
আর যে প্রশ্নটা এর মধ্যে থেকেই উঠে আসছে, তা হলো, সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল যুগের পর কি বাংলায় তেমন কোনো পরিচালক উঠে আসেননি, তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ কি হয়নি, যা আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি পেতে পারে? বিদেশি পরিচালক, প্রযোজকরা কি এখন আর আগ্রহী নন বাংলা বা ভারতীয় সিনেমা সম্পর্কে? বিশিষ্ট চিত্র সমালোচক নির্মল ধর বিশ্বের প্রায় সমস্ত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ডেলিগেট হিসেবে, জুরি সদস্য হিসেবে হাজির থাকেন প্রতি বছর৷ তিনি ডয়চে ভেলে-কে স্পষ্ট জানালেন, ‘‘এখনকার (ভারতীয়) সিনেমা নিয়ে খুব একটা আগ্রহ আমি দেখতে পাই না৷ যদিও তাঁরা চানভারতীয় ছবি দেখতে, কিন্তু তাঁরা বলেন ভারতীয় বাস্তবতারছবিটা আমরা দেখতে পাই না৷ যেসব ছবি আমাদের (ওঁদের) কাছে পাঠানো হয় বা আসে, সেখানে ভারতের যে বাস্তবের কথা আমরা জানি, সেটা খুব কম পাই৷ এ কারণে গত কয়েক বছর ধরে বড় বড় চলচ্চিত্র উৎসবে ভারতীয় ছবির প্রতিনিধিত্ব খুবই কম৷
নির্মল ধর পরিষ্কারই বলছেন যে, কিছু বছর আগে মালয়ালি সনেমার কিছু কাজ, কিছু মারাঠি সিনেমা আন্তর্জাতিক দর্শকের কাছে পৌঁছেছিল৷ কিন্তু এখনকার যেসব কাজ, তা যেহেতু উৎসবে যাচ্ছে না, লোকে দেখছেও না৷ কাজেই এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, বাস্তববোধরহিত ভারতীয় সিনেমা কোনোভাবেই উৎসাহিত করছে না বিশ্বের চলচ্চিত্র রসিকদের৷ ভারতীয় সিনেমার জয়যাত্রা থমকে আছে সেই ১৯৫৫ সালের পথের পাঁচালিতেই৷