পরিবহণ ধর্মঘটের নামে নৈরাজ্য, নেপথ্যে কারা?
২৮ অক্টোবর ২০১৮এমনকি রোগীবাহী এ্যাম্বুলেন্সও হামলার শিকার হয়৷
রবিবার ৪৮ ঘন্টা পরিবহণ শ্রমিক ধর্মঘটের শুরুতেই সকালে শ্রমিকদের কয়েকটি দল ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় জড়ো ব্যক্তিগত গাড়ি চালকদের ওপর চড়াও হয়৷ তারা গাড়ি বের করার ‘অপরাধে' ব্যক্তিগত গাড়ি চালকদের শরীরে ও মুখে পোড়া মবিল ঢেলে দেয়৷
কয়েক জায়গায় স্কুল কলেজের শিক্ষার্খীদের ড্রেসেও পোড়া মবিল মেখে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে৷ যাত্রাবাড়ি এলাকায় এরকম পোড়া মবিল ঢেলে দেয়ার ঘটনার কয়েকটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে৷
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী ডয়চে ভেলের কাছে মবিল ঢেলে দেয়ার ঘটনা স্বীকার করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘যাত্রাবাড়ি এলাকায় যারা পোড়া মবিল মেখে দিয়েছে তাদের একজনকে আমরা চিহ্নিত করেছি৷ সে আমাদের শ্রমিক সংগঠনের সদস্য৷ তবে তাকে এই কাজ করতে বলা হয়নি৷ কেন করেছে তা আমরা জানার চেষ্টা করছি৷''
ব্যক্তিগত গাড়ি চালক ছাড়াও সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেল চালকদের ওপরও চড়াও হন শ্রমিকরা৷ এছাড়া এসব ঘটনার ছবি তুলতে গেলে ফটো সাংবাদিকদের ওপরও হামলা করা হয়৷
পরিবহণ শ্রমিক ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশন, যার কার্যকরী সভাপতি নৌমন্ত্রী শাজাহান খান৷ সকালে সচিবালায়ে সাংবাদিকরা তাকে এই ধর্মঘটের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘‘আমি জানি না , আমি কিছু জানি না৷ আমি এটা নিয়ে কিছু বলতে চাই না৷''
শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের এক সমাবেশের মাধ্যমে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সহ-সভাপতি সাদিকুর রহমান হিরু সড়ক পরিবহণ আইন-২০১৮ ধারা সংশোধনে তাদের ৮ দফা দাবি আদায়ে ২৮ ও ২৯ অক্টেবর ৪৮ ঘন্টার শ্রমিক ধর্মঘটের ডাক দেন৷ তিনি ওই সমাবেশে বলেন, ‘‘ফাঁসির আইন মাথায় নিয়ে আমরা সড়কে গাড়ি চালাতে পারব না৷ সরকারের বিভিন্ন দফতরে আমরা গিয়েছি৷ ঘোষিত ৮ দফা মেনে নিতে হবে৷ দাবি মানাতেই ২ দিনের পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়েছে৷ এরপর দাবি মানা না হলে সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য পরিবহন ধর্মঘট ডাক দেওয়া হবে৷''
পরিবহণ শ্রমিক ধর্মঘটের কারণে সারাদেশে গণ পরিবহণ ও দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে৷ রাজধানী ঢাকায় গণপরিবহণ না থাকায় যাত্রীরা চরম বিপাকে পড়েছেন৷ বিশেষ করে অফিসগামী এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের দুর্ভোগ চরমে ওঠে৷ তবে এ্যাপ ভিত্তিক যানবাহন ছিল প্রচুর৷ একারণে কোথাও কোখাও তীব্র যনজটেরও সৃষ্টি হয়৷ সিএনজি চালিত অটোরিকশাও রাস্তায় নামে৷ তবে হামলার আতঙ্কে ছিলেন তারা৷
শ্রমিকদের আট দফা দাবিগুলো হলো- সড়ক দুর্ঘটনায় সব মামলা জামিনযোগ্য করতে হবে, শ্রমিকদের অর্থদন্ড ৫ লাখ টাকা প্রত্যাহার, সড়ক দুর্ঘটনার তদন্ত কমিটিতে শ্রমিক প্রতিনিধি রাখতে হবে, ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা ৫ম শ্রেণি করতে হবে, ওয়েস্কেলে জরিমানা কমানো ও শাস্তি বাতিল, সড়কে পুলিশি হয়রানি বন্ধ, গাড়ি রেজিস্ট্রেশনের সময় শ্রমিকের নিয়োগপত্রে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষরের ব্যবস্থা রাখতে হবে ও সব জেলায় শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের পর লাইসেন্স ইস্যু ও লাইসেন্স ইস্যুর সময় হয়রানি বন্ধ করতে হবে৷
তবে ৮ দফা দাবির লিফলেটের বক্তব্যে বলা হয়েছে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে ৩০২ ধরারায় হত্যা মামলার বিধান করা হয়েছে৷ আমরা ফাঁসির দড়ি নিয়ে গাড়ি চালাতে পারব না৷ কিন্তু বাস্তবে নতুন সড়ক পরিবহণ আইনে হত্যা মামলার কোনো বিধান নেই৷ সাধারণভাবে দুর্ঘটনার মামলার বিধান আছে৷ আর তাতে সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছরের কারাদণ্ড৷ আর বলা হয়েছে যদি তদন্তে ইচ্ছাকৃত নরহত্যা প্রমাণ হয় তাহলে হত্যা মামলায় রূপান্তর করা যাবে৷''
হত্যা মামলার বিধান না থাকার পরও কেন এই আন্দোলন জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, ‘‘না সরাসরি হত্যা মামলার বিধান না থাকলেও তদন্তে প্রমাণ হলে হত্যা মামলা হবে৷ কেউ কি ইচ্ছা করে দুর্ঘটনা ঘটায়? আর মামলা জামিন অযোগ্য করা হয়েছে৷ আমরা ফাঁসির দড়ি মাথায় নিয়ে গাড়ি চালাতে পারব না৷ সবার আগে আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে৷ মন্ত্রী এমপি হতে কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগেনা৷ আমোদের কেন লাগবে? আর পুলিশ আমাদের সারাক্ষণ হয়রানি করে এসব বন্ধ করতে হবে৷''
তিনি দাবি করেন, ‘‘আমরা এক মাস আগে সরকারকে নোটিশ দিয়েছি কিন্তু সরকার আমাদের সঙ্গে বৈঠক করেনি৷ ৪৮ ঘন্টায় আমাদের দাবি আদায় না হলে আমরা আরো কঠোর কর্মসূচি দেব৷''
এদিকে সকালে সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এখন আইন সংশোধন করা সম্ভব নয়৷ অন্যদিকে, শ্রমিক নেতারা বলছেন, ধর্মঘট প্রত্যাহার সম্ভব নয়৷
সরকার সমর্থক সড়ক পরিবহণ শ্রমিক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হানিফ খোকন ডয়চে ভেলরে কাছে দাবি করেন, ‘‘এই ধর্মঘটের পিছনে একটি মহলের ইন্ধন আছে৷ তারা সরকারকে ব্রিবতকর অবস্থায় ফেলতে চায়৷ আমাদের শ্রমিকরা যানবাহন নিয়ে রাস্তায় নামতে চাইলে তাদের ওপর হামলা করা হয়৷ সিএনজি অটোরিকশার ওপরও হামলা হয়েছে৷''
তিনি আরো দাবি করেন, ‘‘যারা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা বিএনপি ও বাসদের লোক৷'' তবে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান নিরব কেন? জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি৷
এদিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘‘শ্রমিকরা আইন ভালোভাবে না পড়েই আন্দোলনে নেমেছেন৷'' আর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছেন, ‘‘ধর্মঘটের নামে নৈরাজ্য করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে৷''এর জবাবে ওসমান আলী বলেন, ‘‘আমরা ২০ দল নয় যে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া যাবে৷ আমরা ট্রেড ইউনিয়ন করি৷ আমরা শ্রমিক৷ আমাদের দাবি মানতে হবে৷ আমাদের বিএনপি'র লোক বলা ঠিক না৷ এর আগে বিএনপি'র অবরোধের মধ্যে সরকারের কথায় আমরা গাড়ি চালিয়েছি৷ আমরা বিএনপি'র লোক হই কিভাবে!''