পরিবারের আনন্দেই নারীর সুখ
২৩ জুলাই ২০২১অনেকের মতো আমার কাছেও ঈদ মানে শৈশব ফিরে যাওয়া৷ নতুন জামা জুতো পরে চুলে লাল ফিতে বেধে বড়দের সাথে ঘুরে বেড়ানো৷ কোনো দায়-দায়িত্ব নেই, শুধুই আনন্দ! যা এখন কেবল স্মৃতি!
আমি বেড়ে উঠেছি বিশাল এক যৌথ পরিবারে৷ আমার বাবা, চাচা দুই ভাইয়ের যৌথ সংসারে এমনিতেই এত লোকের রান্নাবান্না তার ওপর ঈদ হলে তো কথাই নেই, বিশেষকরে কোরবানি ঈদ৷ ঈদের আগের রাত থেকেই শুরু হতো মা, চাচীর প্রস্তুতি৷ সেমাই, পায়েসের জন্য পেস্তা বাদামের খোসা ছাড়ানো, ঘর গোছানো, কোরবানির গরুর মাংসের জন্য শিল পাটায় আদা, রসুন, পেয়াজসহ নানা মসলা বাটার ধুম৷ ছেলেবেলায় সেসব অনেকটা বিয়ে বাড়ির মতো লাগতো ! ভোর থেকেই শুরু হত খাওয়া-দাওয়া তারপর বাড়ির ছেলেরা সেজেগুজে ঈদের জামাতে যেত৷ তারা ফিরে আসার আগেই মা চাচীর রান্নার আয়োজন শুরু যেন কোরবানি গরুর মাংস ঝটপট এক হাড়ি রান্না করা যায়৷ প্রথম হাড়ির মাংসের স্বাদই আলাদা!
গরু কোরবানি শেষে কিছুক্ষণ পরপরই রান্নাঘরে মাংস আসতো আর বাড়ির গৃহিনীরা সবাইকে খাওয়ানোর জন্য মনের আনন্দে সেসব রান্না করতেন৷ পাশাপাশি রান্না হত পোলাও, খিচুড়ি কিংবা সাদাভাত৷ তাছাড়া কোরবানির ঈদ বলে কথা, এত বড় পরিবারের সদস্যদের আবদার মেটাতে চাই মাংস ভুনা, আলু মাংসের ঝোল, কলিজা ভুনা, কাবাব কত কি ! সে যুগে ফ্রিজ না থাকায় সব মাংস রান্না করে ফেলা ছাড়া সংরক্ষণের কোনো উপায়ও ছিল না৷ বাড়িতে দিনভর এভাবেই চলত৷ অন্যদের বাড়িতে কোরবানি মাংস পাঠানো , নিজেদের বাড়িতে আসা মাংসের ব্যবস্থা করার মতো হাজারো কাজ করতেন কোরবানি ঈদে মা, চাচীরা৷ বাড়িতে আসা সব ভিক্ষুকই যেন মাংস পায় সে খেয়ালও রাখতেন তারা৷ এসবের ফাঁকে ফাঁকে পরিবারের সবার খাওয়া-দাওয়ার খোঁজ যেমন রাখতেন তেমনি অতিথি আপ্যায়নেও পুরো নজর থাকত তাদের৷
সারাদিন রান্নাঘরেই থাকতে হত বলে আমাদের ভাইবোনের বন্ধুরা মাকে ঈদের সালাম করতে রান্নাঘরেই যেত৷ সেসময়ে আমার বাবা এবং ভাইদের বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই হিন্দু ধর্মের ছিলেন যাদের বাড়িতে গরুর মাংস রান্না না হলেও কোরবানির মাংস খুব পছন্দ করতেন তারা৷ তাদের আপ্যায়নের দিকেও মা বিশেষ নজর রাখতেন৷ সারাদিন আপ্যায়ন করতেন বন্ধুবান্ধবদের আর রাতের অতিথি ছিলেন আত্মীয় স্বজন৷
ঈদের দিনে আমরা যেমন নতুন জামা পরতাম তেমনি গৃহকর্মীদেরও পরাতেন নতুন কাপড়৷শুধু আমার মা বা চাচীকে ঈদের দিনে নতুন শাড়ি পরতে দেখিনি৷ তারা এতটাই ব্যস্ত যেন তাদের দম ফেলারও ফুসরত নেই! ঈদের এত আয়োজন, হৈচৈ, খাওয়া-দাওয়া শুনতে কিন্তু বেশ লাগে! ঈদের আনন্দকে পরিপূর্ণ করতে কী খাটুনি-না করতেন আমাদের মা-চাচীরা৷ সারাদিন এত রান্না , এতগুলো ভাইবোনের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশীসহ কত অতিথি-ই না আসতো বাড়িতে৷ সব দায়িত্ব পালনের পরও মায়ের মুখের হাসি থাকতো অমলিন৷ তারাই বলতেন, পরিবারের সুখই তাদের সুখ, স্বামী সন্তানের আনন্দেই তাদের আনন্দ! সেখানে স্বার্থ নেই, নেই কোনো শর্ত! মা, চাচী খালারা বলতেন তাদের মা শাশুড়িরাও নাকি এমনই ছিলেন৷ কি করে যে পারতেন এতকিছু সেটাই মাঝে মাঝে ভাবি! আমরা বোনেরাও তাদের অসীম ধৈর্য নিয়ে আলোচনা করি অনেকসময়৷
আমার বিয়ের আগে মানে বিদেশে আসার আগে পর্যন্ত এমন ঈদই দেখেছি আমাদের পরিবারে৷ বিয়ের পরে একটি কোরবানি ঈদই শশুরবাড়িতে করা সুযোগ হয়েছে৷ ঈদের আনন্দ ধরে রাখতে সে পরিবারেও শাশুড়িতুল্য সব নারীকেই ব্যস্ত দিন কাটাতে দেখেছি৷
আমার সংসার শুরু জার্মানিতে৷ বিয়ের আগে অন্যান্য বাঙালি মা বাবার মতো আমাদের বোনদেরও আগলে রাখতেন তারা৷ ঈদের দিনে ঘর গোছানো বা এধরনের টুকটাক কাজ ছাড়া তেমন কিছুই হয়তো করা হয়নি৷ আর সেই আমি-ই জার্মানির মাটিতে পা ফেলে সেদিনই রান্না করেছি৷ তবে মজার ব্যাপার হলো, সেসময়ে বাংলা বিভাগের সবাই আমার প্রথম রান্নার স্বাদু বা স্বাদহীন যাই-ই হোক না কেন, গ্রহণ করেছেন৷
জার্মানিতে কয়েকবার কোরবানিও দিয়েছি৷ এখানেও কোনো কোনো নারীকে দেখি কোরবানির মাংস থেকে শুরু করে সব কাজ নিজেই করেন৷
আর আমার বোনেরা, ভাবীরা, ননদ, জায়েরা ঈদের আয়োজনে কম যায়না! অ্যামেরিকায় খুব আয়োজন করে ঈদ উদযাপন করা হয়, বোনেরা সবাই অ্যামেরিকায়, সেখানে কেউ কেউ কর্মীজীবী হলেও কোরবানি দেওয়াসহ সব কাজ নিজেরাই করে থাকে৷ রান্নাবান্না, অতিথি আপ্যায়ন ছাড়াও তারা ঈদের জামাতে শরিক হয়৷ শত কাজের মাঝেও প্রবাসী বাঙালি নারীরা একে অপরের বাড়িতেও বেড়াতে যায়৷ দুই একবার আমারও সেসব ঈদ অয়োজনে অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়েছে৷ আসলে একই সাথে ঘর এবং বাইরে সামাল দিতে নারী-ই পারে!
বিদেশে জন্ম নেওয়া আমার মেয়ে এবং ভাইবোনের মেয়েরাও ঈদ আয়োজনে অংশ নেয়, রান্না বা কেনাকাটায় মাকে সাহায্য করে৷ অনেকে আবার নতুন কিছু রান্না করে ঈদের চমক দেয় পরিবারকে৷
ঈদ মানে আনন্দ, একথা প্রথম মনে এলেও কোরবানি ঈদ শুধু আনন্দ নয়, আত্মত্যাগ ও দায়িত্ব পালনের উৎসব৷ কয়েক প্রজন্মের নারীদের এই উৎসব পালন করতে দেখেছি৷ সময়ের সাথে নারীর অবস্থানগত পরিবর্তন এলেও আমার দৃষ্টিতে, আত্মত্যাগ ও দায়িত্ব পালনে নারীর অবদানকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগই নেই!