পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি আর কত নীচে নামবে
১৭ জুলাই ২০২০তাঁর সঙ্গে রাজ্যপালের সম্পর্ক কখনওই বিশেষ 'মধুর' নয়। অসাংবিধানিক শব্দ এর আগেও রাজ্যপালের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন তিনি। তবে বৃহস্পতিবার পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় সম্পর্কে যে শব্দ ব্যবহার করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তা নজিরবিহীন। যদি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বক্তব্য, ২০২১ সালের নির্বাচন যত কাছে আসবে, রাজ্যপাল-মুখ্যমন্ত্রী উত্তাপ তত বাড়বে। বস্তুত সে ইঙ্গিত মিলেছে রাজ্যের বিজেপি শিবির থেকেও। এখানে বলে নেওয়া ভালো, রাজ্যপাল যেভাবে লাগাতার টুইট করে যে ভাষায় মুখ্যমন্ত্রীকে আক্রমণ করেন, জবাবদিহি চান, সেটাও নজিরবিহীন। সাম্প্রতিককালে কোনো রাজ্যপালকে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রতিদিন এরকম শব্দবান ছুঁড়তে দেখা যায়নি।
যে ঘটনা নিয়ে এ বার বিরোধ চরমে তার সূত্রপাত রাজ্যপালের একটি বৈঠককে কেন্দ্র করে। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল রাজ্যের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্যও বটে। তবে এই পদ নেহাতই আনুষ্ঠানিক। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রাজ্যপাল আচার্য হিসেবে যোগ দেন। এটাই চিরাচরিত দস্তুর। কিন্তু জগদীপ ধনখড় পশ্চিমবঙ্গে আসার পর থেকে নিজের পদকে কেবল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছেন না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি সমান্তরাল প্রশাসন তৈরি করার চেষ্টা চালাচ্ছেন, এই অভিযোগ বহু দিনের। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের তিনি নির্দেশ দেন, তাঁর সঙ্গে বৈঠক করতে হবে। কিন্তু রাজ্য শিক্ষা দফতরের অনুমোদন না নিয়ে ওই বৈঠক ডাকা হয়েছে এই অভিযোগে একজন ছাড়া কোনও উপাচার্যই ওই বৈঠকে যোগ দেননি। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে সে বিষয়ে ক্ষোভও প্রকাশ করেন রাজ্যপাল। আর তাতেই সংঘাত তীব্র হয়।
মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি রাজ্যপালের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে শুরু করেন। তিনি বলেন, ''কেউ আমাকে আঘাত না-করলে সাধারণত কাউকে আমি আক্রমণ করি না। কিন্তু এটা একতরফা হয়ে যাচ্ছে।'' এরপরেই মেজাজ হারিয়ে মমতা বলেন, ''মহামান্য রাজ্যপাল মহাশয়, প্রতিদিন কি আপনাকে কোটি বার প্রণাম করতে যেতে হবে! নির্বাচিত লোকেরা কি চাকরবাকর হয়ে গিয়েছে? নিজেকে সামলান।'' তাঁর অভিযোগ, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কিংবা বিজেপিও যে ভাষায় কথা বলে না, রাজ্যপাল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে সেই ভাষায় কথা বলছেন।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, রাজ্যপাল একটি সাংবিধানিক পদ। জগদীপ ধনখড় যা যা করছেন, সাংবিধানিক ভাবে সব সময় তা করা যায় কি না, এ বিষয়ে বিতর্ক হতেই পারে। রাজ্যপাল যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে লাগাতার আক্রমণ করে যাচ্ছেন, সে কথাও সুবিদিত। রাজ্যপালের এক্তিয়ারের প্রশ্ন ওঠাও অবাঞ্ছিত নয়। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী চেয়ারে বসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যপাল সম্পর্কে যা বলেছেন তা কেবল অনভিপ্রেত নয়, অসাংবিধানিকও বটে। একজন রাজ্যপাল সম্পর্কে এ ভাবে মন্তব্য করা অনুচিত।
রাজ্যপাল এবং মুখ্যমন্ত্রীর এই সংঘাত নতুন নয়। বছরখানেক আগে ধনখড় রাজ্যপাল নিযুক্ত হওয়ার পর থেকেই প্রকাশ্যে সংঘাত শুরু হয়। টুইট করে, সাংবাদিক বৈঠক করে রাজ্যপাল লাগাতার সরকারের নিন্দা করে গিয়েছেন। সরকারও তার পাল্টা জবাব দিয়েছে। কিন্তু এ দিনের সংঘাতে যে ভাষার ব্যবহার হয়েছে তা নজিরবিহীন।
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, সিনেমা শুরু হলো মাত্র। ২০২১ সালের নির্বাচন যত কাছে আসবে, ততই নতুন নতুন ক্লাইম্যাক্স তৈরি হবে। বস্তুত রাজ্যের বিরুদ্ধে আরও সুর চড়িয়েছে বিরোধী দল বিজেপি। এর আগে অনেকবার রাজ্য সরকারের উপর কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ দাবি করেছে বিজেপি। কিন্তু দুই দিন আগে দিল্লিতে এসে রাজ্য বিজেপির একটি দল রাষ্ট্রপতি এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠি দিয়ে গিয়েছে। তাতে পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতির শাসন দাবি করা হয়েছে। রাজ্যে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা তৈরি না হলে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হয় না।
অনেকেই মনে করছেন, ভোটের আগে তৃণমূলের উপর চাপ বাড়াতেই বিজেপি এই নতুন অস্ত্র ব্যবহার করল। এবং ২০২১ সালের নির্বাচনের অন্যতম এজেন্ডা তৈরি করে দিল। এখন সব পক্ষই এ নিয়ে বিতর্ক করবে। আর রাষ্ট্রপতির শাসনের অর্থ রাজ্যপালের হাতে ক্ষমতা চলে যাওয়া। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে রাজ্যপালের কাছে রাষ্ট্রপতি রিপোর্ট চাইতে পারেন। রাজ্যপালও যদি সেখানে বিজেপির বক্তব্য সমর্থন করেন, তা হলে ভোটের আগে পশ্চিমবঙ্গে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
এসজি/জিএইচ (আবপ)