পশ্চিমবঙ্গে এ সব হচ্ছেটা কী
৯ অক্টোবর ২০২০যত দূর মনে পড়ছে ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগের ঘটনা। সে বার নবান্ন অভিযান করেছিল সিপিএম। পুলিশের সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষ হয়েছিল সিপিএম কর্মীদের। বেছে বেছে সে বার সাংবাদিকদের রাস্তায় ফেলে পিটিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ। বৃহস্পতিবার বিজেপির নবান্ন অভিযান ঘিরে কলকাতা এবং হাওড়ায় যা ঘটল, তা ওই দিনের চেয়েও ভয়াবহ।
বৃহস্পতিবারের ঘটনার সঙ্গে ২০১৭ সালের ঘটনার অবশ্য অনেক তফাত। ওই দিনের মিছিল কভার করতে যাওয়া পেশাদার সাংবাদিকদের বেধরক পিটিয়েছিল পুলিশ। অন্তত ৫০ জন সাংবাদিককে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ভর্তি করতে হয়েছিল হাসপাতালে। বৃহস্পতিবার পুলিশ যাঁদের পিটিয়েছে, রঙিন জল ভরা জল কামান দেগে যাঁদের সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা করে দিয়েছে তাঁরা মূলত বিজেপি কর্মী। বৃহস্পতিবারের একাধিক মিছিল থেকে ওই বিজেপি কর্মীরা যে যথেষ্ট উস্কানি দিয়েছিল, তাও পরিষ্কার। হাওড়া ময়দানে তাঁরা বোমা ফাটিয়েছে বলে অভিযোগ। কর্মী সমর্থকদের কাছ থেকে পিস্তল উদ্ধার হয়েছে বলে অভিযোগ। বিজেপির একাধিক মিছিল থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে নাগাড়ে ইট এবং বোতল ছোড়া হয়েছে। ভাঙা হয়েছে পুলিশের ব্যারিকেড। ফলে পুলিশও পাল্টা মার দিয়েছে। যাতে গুরুতর আহত হয়েছেন বিজেপির উত্তর কলকাতার নেতা রাকেশ সিং, রাজ্যের শীর্ষস্থানীয় নেতা রাজু বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন্দ্রীয় নেতা অরবিন্দ মেননের উপরেও লাঠিচার্জ হয়েছে। তিনিও আহত হয়েছেন।
কলকাতায় এমন ঘটনা যে খুব নতুন, এ কথা বলা যায় না। বাম আমলে পুলিশের গুলিতে ২১ জুলাই একাধিক কংগ্রেস কর্মী নিহত হয়েছিলেন। যা নিয়ে পরে কমিশনও বসেছিল। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন পর্বে পুলিশ ট্রিগার হ্যাপি হয়ে গিয়েছিল বলে অনেকেই মনে করেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশও সেই একই পথে হেঁটেছে।
প্রশ্ন মারমুখী পুলিশের চেহারা নিয়ে নয়। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির চরিত্র নিয়ে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি হিংসাত্মক ছিল না, এ কথা বলছি না। কিন্তু ৩৬৫ দিন যে ভাবে খুন-খারাপির রাজনীতি শুরু হয়েছে গত কয়েক বছর ধরে, পরিস্থিতি সম্ভবত এতটাও ঘোলাটে ছিল না। গোটা ভারতে পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম পরিচয় মিছিল নগরী বলে। যে কোনও ঘটনায় এখানকার রাজনৈতিক দলগুলি এবং সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করেন-- এ কথা সর্বজনবিদিত। যা জানা ছিল না, তা হলো, প্রতিবাদ করলেই আক্রান্ত হতে হয়। বর্তমানে ঠিক সেটাই ঘটছে। ব্যক্তিগত ভাবে কে কোন রাজনীতির পক্ষে, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। জরুরি কথা হলো, সকলেই প্রতিবাদ করার সমান সুযোগ পাবেন। বিরোধী রাজনীতি করলেই খুন হয়ে যেতে হবে, এ কথা খুব গণতান্ত্রিক নয়। অথচ সেটাই ঘটছে। বিরোধী রাজনীতি করলে মেরে গাছে টাঙিয়ে দেওয়া হবে, এ বড় সভ্যতার চিহ্ন নয়। অথচ সেটাই ঘটছে। প্রতিদিন রাজ্যের কোনও না কোনও প্রান্তে খুন হচ্ছে। বিরোধীদের সঙ্গে শাসকদল তৃণমূলের লোকেরাও মারা যাচ্ছেন। গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে জেরবার শাসকদল। এর দায় কে নেবে?
এর দায় নিতে হবে শাসককেই। প্রশাসন যদি শক্ত হয়, শাসক যদি আইনের শাসন কায়েম রাখে, তা হলে এমন ঘটনা ঘটতে পারে না। খুন কখনওই রাজনৈতিক বার্তা হতে পারে না। খুনোখুনি আইনশৃঙ্খলার বিষয়। আইন দিয়েই প্রশাসনকে তার মোকাবিলা করতে হবে। সমস্যা হলো, পশ্চিমবঙ্গে তা ঘটছে না। দীর্ঘ দিন ধরেই ঘটছে না।
দায় নিতে হবে বিরোধীদেরও। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি যে রাজনীতির আমদানি ঘটিয়েছে, তা মোটেই খুব শান্তিপূর্ণ নয়। ভেদাভেদের রাজনীতি করে মানুষকে উত্তেজিত করে দেওয়া মোটেই বৈধ রাজনৈতিক পথ নয়। প্রতিবাদ করাটা অধিকার। বিক্ষোভ দেখানোও অধিকার। কিন্তু প্রতিবাদের নামে ইটবৃষ্টি, বোতলবৃষ্টি গণতান্ত্রিক দেশে বৈধ হতে পারে না। বৃহস্পতিবার আন্দোলনের নামে বিজেপি যে কাজ করেছে, তা সমর্থনযোগ্য নয়। সমর্থনযোগ্য নয়, যে কায়দায় পুলিশ তা প্রতিরোধ করেছে।
কলকাতার রাস্তায় জল কামানের ব্যবহার এর আগেও অনেক হয়েছে। ২০১৭ সালের বাম মিছিলে যে সাংবাদিকরা মার খেয়েছিল, এই অধমও তার একজন। অন্তত এক দশক কলকাতায় রাজনৈতিক মিটিং মিছিল কভার করেছি, কিন্তু কোনোদিন এমন রঙিন জলের ব্যবহার দেখিনি। অনেকেই হাসাহাসি করছেন পুলিশের অমন রঙিন জল ব্যবহার করে প্রতিবাদকারীদের 'ভূত' বানিয়ে দেওয়ায়। বিষয়টা কি সত্যিই হাসির? প্রতিবাদকারীকে এ ভাবে জনবিচ্ছিন্ন করার জন্য রঙিন জল ব্যবহার করা কি খুব গণতান্ত্রিক? ফ্যাসিস্ট দেশে এমন হয় শুনেছি।
২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ভোট। নির্বাচন যত এগোচ্ছে, সহিংসতা ততই বাড়ছে। এর দায় প্রশাসনকে নিতে হবে। এর দায় রাজনৈতিক দলগুলিকেও নিতে হবে। মুশকিল হলো, কেউ কোনও দায় নেয় না। সকলেই ভুলে যায়, অন্যের দিকে একটা আঙুল তুললে, নিজের দিকে বাকি তিনটে আঙুল থাকে।