পশ্চিমবঙ্গে কেন লোকালয়ে এত ঘনঘন বাঘ চলে আসছে?
১৫ জানুয়ারি ২০২২গত দুই দশকের হিসাব দেখলে বোঝা যাবে, বাঘের আক্রমণে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে৷ ২০০০ সাল থেকে প্রথম দশকে গড়ে বাৎসরিক মৃত্যু ২২-২৩ জনের৷ ২০১০ থেকে পরের দশকে এই সংখ্যাটা নেমে আসে ৮-৯ জনে৷ সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে দক্ষিণ ২৪ পরগনার যে তিনটি ব্লকে সবচেয়ে বেশি মানুষ বাঘের হামলার শিকার হয়, সেগুলি হলো গোসাবা, কুলতলি ও বাসন্তী৷ সবচেয়ে বেশি বাঘের হামলার খবর গোসাবা থেকে পাওয়া যায়৷ গত বুধবার জনপদে ঢুকে পড়া একটি বাঘ বনকর্মীরা খাঁচায় ভরেছে৷ শেষ আড়াই মাসে বাঘের গ্রামে অনুপ্রবেশের ঘটনা দশেরও বেশি৷ ফলে সুন্দরবনের এই তিনটি ব্লকে এখন ভরপুর আতঙ্ক৷
এর আগেও বারবার লোকালয়ে এসে পড়েছে বাঘ৷ এটা বাঘের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য বলেই বিশেষজ্ঞদের দাবি৷ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন অংশে গত নভেম্বর মাস থেকে অপেক্ষাকৃত ঘনঘন রয়েল বেঙ্গল ঢুকে পড়েছে গ্রামে৷ কোথাও বাঘের হামলায় গ্রামবাসী বা মৎস্যজীবীর মৃত্যু হয়েছে, কোথাও গৃহপালিত পশু মারা পড়ছে৷ একাধিক বিশেষজ্ঞ এজন্য বাঘের খাদ্যাভাবকে দায়ী করেছেন৷ বিভিন্ন কারণে বনাঞ্চলে খাদ্যের অভাব হতে পারে৷ ‘ইন্টারন্যাশানাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার' সংগঠনের দীর্ঘদিনের ক্যাট স্পেশ্যালিস্ট প্রণবেশ সান্যাল বলেন, ‘‘সুন্দরবনের জঙ্গল আরও ঘনত্বপ্রাপ্ত হয়েছে, ফলে শিকার বাঘের চোখে পড়ছে না৷ বাঘ যদি বুড়ো হয় তাহলে সমস্যা আরো বেশি৷ অথচ সেই বাঘ নদীর ওপারে ফাঁকা জমিতে গবাদি পশু চরতে দেখছে৷ সেগুলি ধরতে লোকালয়ে চলে আসছে৷’’ শুধু সেটাই কি রয়্যাল বেঙ্গলের লোকালয়ে ঘনঘন এসে পড়ার কারণ?
বাঘ যাতে গ্রামে ঢুকে না পরে সেজন্য জাল দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে বনদপ্তর৷ কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগে অনেক জায়গায় জাল ছিন্ন হয়ে গেছে৷ তার ফাঁক গলে শিকারের সন্ধানে থাকা বাঘ লোকালয়ে চলে আসছে৷ ওয়ার্ল্ডওয়াইড ফান্ড ফর নেচার, ডাব্লিউডাব্লিউএফ সুন্দরবন প্রোগ্রামের অধিকর্তা অনামিত্র অনুরাগ দণ্ড মনে করেন, ‘‘হতে পারে জাল মানুষই নষ্ট করেছে, জালগুলো পরীক্ষা করে দেখা দরকার৷ এছাড়া জঙ্গলে বাঘের জায়গা বাড়ছে না, বংশবৃদ্ধি হলে তারা ছড়িয়েছিটিয়ে যাবেই৷’’
রাজ্যের বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক অবশ্য খাদ্যাভাবের কারণটি নাকচ করেছেন৷ তার মতে, খাবারের অভাব হয়নি৷ এটা বাঘের বংশবিস্তারের সময়৷ তাই সঙ্গীর খোঁজে তারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়৷ সেই ফাঁকে বাঘ লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে৷ এই দাবির সমর্থনে সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের ডেপুটি ফিল্ড ডিরেক্টর জোন্স জাস্টিন বলেন, ‘‘এটা বাঘের প্রজননের সময়৷ বাঘ বা বাঘিনীর বয়স বেশি হলে তাকে তার রাজত্ব থেকে সরে আসতে বাধ্য করা হয়৷ তবে এটাই একমাত্র কারণ নাও হতে পারে৷'' নির্দিষ্ট কোনো একটি কারণে বাঘ লোকালয়ে চলে আসে না৷ অনেকগুলি কারণ এর পেছনে থাকতে পারে৷ এমনটাই মনে করেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রাণিসম্পদ বিভাগের সহকারী অধিকর্তা শিবাজী ভট্টাচার্য৷ তিনি বলেন, ‘‘লোকালয়ে বাঘ না বাঘিনী হাজির হচ্ছে, সেটাও জানাতে হবে৷ বাঘিনী এই মৌসুমে বাঘকে আহ্বান করে৷ কোনো বাঘ তার প্রস্তাবে রাজি না হলে বাঘিনীকে তাড়িয়ে বের করে দেয়৷ বাঘিনীকে নিজের বাসস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে হয়৷ স্থানান্তরের সময় গ্রামে ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা থাকেই৷’’
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের বিভিন্ন ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্পে বনাঞ্চলের সীমানা নির্দিষ্ট৷ কিন্তু সুন্দরবনের ক্ষেত্রে তা নয়৷ সুন্দরবনের ক্ষেত্রে জোয়ার-ভাটার সঙ্গে সঙ্গে বাঘের বিচরণভূমি কমে যায়৷ একটি বাঘের জন্য দশ বর্গ কিলোমিটার বাসস্থান দরকার হয় ডাঙায়৷ সেটা সুন্দরবনে সবসময় পাওয়া যায় না৷ এমনকি যাত্রিবাহী ভেসেল, মাছ ধরার ট্রলার ঢুকে পড়েও বাঘকে বিরক্ত করতে পারে৷ একই বাঘ নাকি আলাদা বাঘ বেরোচ্ছে সেটাও দেখতে হবে৷ শিবাজী বলেন, ‘‘পাশাপাশি প্রাণীটি কতটা সুস্থ বা বয়স্ক, সেটাও জানা দরকার৷ বাঘ অসুস্থ বা বৃদ্ধ হলে জঙ্গলে শিকার ধরতে পারে না৷ তখন লোকালয়ে এসে তাকে সুলভ শিকারের ব্যবস্থা করতে হয়৷’’