পশ্চিমবঙ্গের দাপুটে মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ অভিনেত্রীর বাড়ি থেকে ২২ কোটি টাকা বেরোচ্ছে, অভিনেত্রী বলছেন, ওই টাকা মন্ত্রী তাকে রাখতে দিয়েছেন, এরকম ঘটনা সাম্প্রতিককালে হয়নি। সারদাকাণ্ডে এরকমভাবে কোনো মন্ত্রী বা রাজনৈতিক নেতা বা তার ঘনিষ্ঠের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে এত টাকা উদ্ধার হয়নি। নারদ-কেলেঙ্কারিতে নেতাদের টাকা নেয়ার দৃশ্যের ভিডিও আমরা দেখেছি, কিন্তু সে সামান্য কয়েক লাখ টাকা। সেটাও তারা দলের কাছে জমা করেছেন বলে দাবি করছেন। এরকম প্রায় ২২ কোটি টাকা, ৫০ লাখের গয়না, রাশিরাশি ডলারের কাহিনি সেখানে নেই। ফলে এইভাবে টাকা উদ্ধার ও তা মেশিনে গুনতে রাত কাবার হয়ে যাওয়ার গল্প একেবারে নতুন। পার্থ চট্টোপাধ্য়ায়ের মতো দাপুটে মন্ত্রী গ্রেপ্তার, বাংলা ও ওড়িয়া সিনেমার অভিনেত্রীর কাছ থেকে রাশি রাশি টাকা উদ্ধার, শরীর খারাপ নিয়ে মন্ত্রীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া, বিচারপতির পর্যবেক্ষণ যে, এসএসকেএম প্রভাবশালীদের নিরাপদ আশ্রয়--গত কয়েকদিন ধরে যা চলছে, তাতে কোথায় লাগে বাংলা সিরিয়ালের গল্প!
কিন্তু এতকাণ্ডের পর তৃণমূলের প্রতিক্রিয়া এতটা নরম কেন? এতকিছুর পরেও পার্থ এখনো কেন মন্ত্রী, কেনই বা তিনি তৃণমূলের মহাসচিব? তাকে কেন ওই দুই পদ থেকে সরানো হলো না? এতদিন ধরে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উঠতে বসতে প্রায় প্রতিটি জনসভায় নিয়ম করে অভিযোগ করেছেন, প্রধানমন্ত্রী মোদী রাজ্যের মন্ত্রী ও নেতাদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার রাজনীতি করার জন্য সিবিআই, ইডি-কে পিছনে লাগিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু অন্তত এই ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ অভিনেত্রীর বাড়ি থেকে ২২ কোটি টাকা পাওয়া গেল। আমরা জানি, যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ আদালতে দোষী সাব্যস্ত না হচ্ছেন, ততদিন পর্যন্ত কেউ অপরাধী হন না। ততদিন পর্যন্ত তিনি অভিযুক্ত। পার্থ চট্টোপাধ্য়ায়কে আমরা একবারের জন্যও অপরাধী বলছি না, বলতে পারিও না। তিনি অভিযুক্ত।
অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে ২২ কোটি টাকা পাওয়া গেছে। অর্পিতার দাবি, সেই টাকাটা পার্থই তাকে রাখতে দিয়েছিলেন। এই দাবি যদি সত্যি হয় তো, পার্থের বিরুদ্ধে অভিযোগটা খুবই গুরুতর। সেই সঙ্গে ইডি আদালতে জানিয়েছে, অর্পিতার ফ্ল্যাট থেকে মন্ত্রীর নামাঙ্কিত সরকারি খাম এবং এসএসটি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বেশ কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে। এটাও গুরুতর অভিযোগ এবং এই ঘটনাপ্রবাহের পর তো একটা প্রত্যাশা থেকে যায়। হয় পার্থ নিজে যতদিন নির্দোষ প্রমাণিত না হচ্ছেন, ততদিন দল ও সরকারের পদ থেকে ইস্তফা দেবেন অথবা মুখ্যমন্ত্রী নিজে ব্যবস্থা নেবেন। কারণ, গণতন্ত্রে তো এটাই প্রত্যাশিত যে, নেতারা সন্দেহের উপরে থাকবেন। আর এসএসটি নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগও তো নতুন নয়।
আর ভারতীয় রাজনীতিতে এরকম উদাহরণ যে নেই তা নয়। জৈন হাওয়ালা মামলায় লালকৃষ্ণ আডবাণী অভিযুক্ত হওয়ার পর ঘোষণা করেন, অভিযোগমুক্ত না হলে তিনি আর সাংসদ হবেন না। সাংসদ ও দলের সভাপতি পদ তিনি ছেড়ে দেন। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমলে ভুষি কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে কাশীকান্ত মৈত্র সহ দুই মন্ত্রীকে বরখাস্ত করেন সিদ্ধার্থ। ইউপিএ আমলে একের পর এক মন্ত্রী ও সাংসদ অভিযুক্ত হয়ে হয় মন্ত্রিত্ব ছেড়েছেন বা তাদের ছাড়তে বলা হয়েছে। সেই তালিকায় এ রাজা সহ অনেকের নাম রয়েছে।
কিন্তু এক্ষেত্রে এখনো পর্যন্ত তৃণমূলনেত্রী সেরকম কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। অথচ, সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ তার ছিল। এর আগে নারদা ও সারদায় দলের অনেকে অভিযুক্ত হলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় অবিচল ছিলেন। ভোটের সময় দেখা গেছে, মানুষের মনে সেই অভিয়োগ ছায়াপাত করেনি। তারা আবার বিপুল ভোটে মমতাকে জিতিয়েছেন।
কিন্তু সেই পাবলিক পারসেপশন বা জনধারণা বদলাতেও তো সময় লাগে না। যেমন রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে বফর্সের অভিযোগ সারা দেশে এমনভাবে ছড়িয়ে যায়, বাচ্চা ছেলেরা পর্যন্ত বলতে থাকে, গলি 'গলি মে শোর হ্যায়, রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়'। পরে রাজীব যে টাকা নিয়েছেন, আদালতে এমন প্রমাণ হয়নি। ফলে কখন যে মানুষের ধারণা কোন পথে চলবে, তার কোনো সরল অঙ্ক নেই। তবে সেই ধারণার জন্য বসে না থেকে আগেই যদি ব্যবস্থা নেয়া হয় এবং বলা হয়, আদালত নির্দোষ বলা না পর্যন্ত তিনি আর পদে থাকবেন না, তাহলে তৃণমূলনেত্রীর ভাবমূর্তি বাড়ত, ঠিক গণতান্ত্রিক নীতি নিয়ে চলা যেত এবং এটাও বোঝা যেত, গুরুতর অভিযোগ উঠলে মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় ব্যবস্থা নিতে পিছপা হন না।
রাজনীতিতে তো অভিযোগ ওঠে, উঠবেই। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনের বিরুদ্ধে তার বিরোধীরা অভিযোগ করেছিলেন, তিনি নাকি কলকাতার স্টিফেন হাউসের মালিক। প্রচুর দুর্নীতি করেছেন। আর মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছাড়ার পর দেখা গেল, তার সংসার চালানোই দুষ্কর হয়ে উঠেছে। তাই নিছক অভিযোগ হলে এত কথা বলার দরকার হত না।
কিন্তু এবারের পরিস্থিতি অভূতপূর্ণ। তাই চক্রান্তের তত্ব দিয়ে তাকে ঢাকার চেষ্টা করে লাভ হবে না। বরং গত কয়েকদিন ধরে টিভি ও ভিডিওর কল্যাণে মানুষের মনে একটা ধারণা তৈরি হয়ে যাচ্ছে। কাহিনি ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে। অন্তত এখন তো সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নীতি নিয়ে চলুক শাসক দল। আমরা দীর্ঘদিন ধরে দেখে এসেছি, রাজনীতির মধ্যে আর কোনো নীতি প্রায় অবশিষ্ঠ নেই। তাও আমাদের মনে হয়, সব নিশ্চয়ই শেষ হয়ে যায়নি। এরকম ক্ষেত্রে দল উদ্যোগী হয়ে ব্যবস্থা নেবে। না হলে যে সন্দেহ ক্রমশ বাড়বে, বাড়তেই থাকবে।