পিঠার গল্প, জীবনের গল্প
বাংলাদেশে পিঠার ঐহিত্য সুপ্রাচীন৷ ঘরে বানানো সেই পিঠা এখন নগরের দোকানেও পাওয়া যায়৷ আর শীতকালে তো ঢাকার পথে পথে বসে পিঠার দোকান৷ দেখুন ছবিঘরে...
পথের পিঠা
শীতের বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত ঢাকার অলিতে গলিতে পড়ে যায় পিঠা বিক্রির ধুম৷ রাস্তার পাশেই চুলা পেতে তৈরি হয় পিঠা৷ এসব দোকানে ক্রেতাও অনেক৷
চিতই আর ভাপা
পথের পিঠায় চিতই আর ভাপা পিঠারই প্রাধান্য৷ দামও কম৷ গরম ধোঁয়া ওঠা পিঠার এই আয়োজন নগরে শীতের আমেজ এনে দেয়৷ চিতই পিঠার সাথে থাকে নানা ধরনের ভর্তা৷
ভর্তা ফ্রি
রাজধানীতে চিতই পিঠার সাথে নানা ধরনের ভর্তা খাওয়ার রেওয়াজ আছে৷ এই ভর্তার মধ্যে শুটকি, ধনেপাতা, সরিষা বাটাই প্রধান৷ সব দোকানেই পিঠা খেলে ভর্তা বিনা মূল্যে পাওয়া যায়৷
ভর্তাই যখন পিঠার আকর্ষণ
শুক্রাবাদে এরশাদের চিতই পিঠার দোকানে যেন ভর্তাই প্রধান আকর্ষণ৷ এরশাদের মতে, ভর্তার কারণেই তাঁর গ্রাহক বেশি৷ ৫ টাকার চিতই পিঠার সাথে তিনি দেন ১২ রকমের ভর্তা৷ শুধু শুটকি ভর্তাই আছে ৫ প্রকারের৷
এক সাথে ১৬ চুলায় পিঠা
মোহাম্মদপুর হাউজিংয়ে দেখা গেল ১৫-১৬টি চুলায় একই সঙ্গে চিতই পিঠা ভাজার দৃশ্য৷ আছে ভাপা পিঠাও৷ দু’জন নারী এখানে পিঠার ব্যবসা করেন৷ সন্ধ্যা থেকেই পিঠার জন্য ভীড় করেন নগরবাসী৷
অভিনব ডিম চিতই
তাঁদের কেউ শিখিয়ে দেয়নি, স্বাদের ভিন্নতা আনতেই তাঁরা ডিম চিতই ‘আবিস্কার’ করেন৷ ভাজার সময় চালের গোলার সঙ্গে একটি ডিম ভেঙে দেন– হয়ে গেল ডিম চিতই৷ ডিম চিতইয়ের চাহিদাও বেশ৷
সাধারণ উপকরণ
চালের গুঁড়া, গুড়, লবন আর নারকেল– এই হলো চিতই আর ভাপা পিঠার উপকরণ৷
সংসার চালায় পিঠা
বিলকিস বেগমের বাড়ি শরিতপুর৷ ঢাকায় আসেন ১০ বছর আগে৷ মোহাম্মদপুরে এই পিঠা বিক্রি করেন ৫ বছর ধরে৷ ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি – এই তিন মাস তিনি পিঠা বিক্রি করেন৷ স্বামীসহ পরিবারের সদস্য ৬ জন৷ তিনি জানান, পিঠা বিক্রির এই তিন মাসের আয়ে তাঁর প্রায় সারা বছর চলে যায়৷
চুলার বিশেষত্ব!
আরেক পিঠা বিক্রেতা রোজিনা বেগমের দাবি, তাঁদের এই চুলা একটু বিশেষ ধরনের৷ এঁটেল মাটি দিয়ে নীচে স্টিলের প্লেট দিয়ে এই চুলা তাঁরা নিজেরাই তৈরি করেন৷ চুলায় কাঠের আগুনে চিতই আর ভাপা’র স্বাদ নাকি বেড়ে যায়৷
যখন খুশি তখন খাই
সড়কের পাশে এই পিঠার এত চাহিদা কেন? বাসায়ও তো তৈরি করে খেতে পারেন৷ নির্ঝর আর জামান জানান বললেন, বাসায় তো আর প্রতিদিন আয়োজন করা যায় না৷ আর ঝক্কিও অনেক৷ তাই এখানে এসে যখন মন চায় তখনই পিঠা খাই৷
ঢাকায় প্রথম রেস্টুরেন্ট কাম পিঠাঘর
বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে খাবার-দাবার পিঠাঘর সম্ভবত রাজধানীতে প্রথম রেস্টুরেন্টে পিঠা বিক্রি শুরু করে৷ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ফরিদুর রেজা সাগর তাঁর মা, কথা সাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের উৎসাহে রেস্টুরেন্টে পিঠার ব্যবসা শুরু করেন৷ পিঠা ছাড়াও হাঁসের মাংশ, খিচুড়িসহ নানা ব্যতিক্রমী খাবার পাওয়া যায় এখানে৷
কত রকমের পিঠা
খাবার দাবার পিঠাঘরে ১২ রকমের পিঠা তৈরি হয়৷ দোকানের ম্যানেজার রবিউল আলম জানান, ভাপা, পাটিসাপটা, পোয়া, পুলি, চিতই তাঁরা তৈরি করেন৷ শীত কালে চাহিদা বেশি, তবে সারাবছরই তাঁরা পিঠা বিক্রি করেন৷
নিজস্ব ডিজাইন
আজকাল পিঠা তৈরির নানা ধরনের সাজ পাওয় যায়৷ কিন্তু খাবার দাবার পিঠাঘরের সব পিঠাই হাতে ডিজাইন করা হয়৷ কোনো সাজ ব্যবহার করা হয় না৷ এখানে যে-কেনো ধরনের পিঠার হয় ২৫ টাকা৷
শুধুই পিঠার দোকান
বেইলি পিঠাঘরের অবস্থান বেইলিরোড নাটক সরণীতে৷ আর এখানে তারা পিঠার ব্যবসা করেন ২৫ বছর ধরে৷ তাদের রয়েছে ৪০ ধরনের পিঠা৷
বাহারি নামের পিঠা
বেইলি পিঠাঘরে আছে বাহারি সব নামের পিঠা৷ স্বাদেও আছে ভিন্নতা৷ দেশে প্রচলিত পিঠার সাথে তাঁরা যুক্ত করেছেন বিবি খানা, শাহী রস পাকন, ক্ষীর লুচি, লবঙ্গ লতিকা, শাহী জবা, রস ফুল, সুন্দরী পাকনসহ আরো নানা নামের ও স্বাদের পিঠা৷
পিঠা যায় বিদেশে
বেইলি পিঠাঘরের পিঠা ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়৷ দোকান কর্তৃপক্ষ জানায়, এই পিঠার চাহিদা আছে সারা দেশে৷ বঙ্গভবন, গণভবন আর সচিবালয়ে তাঁরা নিয়মিত পিঠা দেন৷
বিদেশিদের নজর কেড়েছে
ঢাকার বিভিন্ন দূতাবাসে যেসব বিদেশি কাজ করেন, তাঁদের আকর্ষণ করতে পেরেছে বেইলি পিঠাঘরের পিঠা৷ এখানে নাকি ভারতের অন্তত ২ জন প্রধানমন্ত্রী পিঠা খেয়েছেন৷ যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা নাকি এই দোকানের নিয়মিত গ্রাহক ছিলেন৷
দামি পিঠা
এখানকার সবচেয়ে দামি পিঠার নাম শাহী মালাই৷ পউরুটি আর দুধের ক্ষীর দিয়ে তৈরি হয় এই পিঠা৷ তাদের দাব, এই পিঠা তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ড৷ প্রতি পিসের দাম ৫০ টাকা৷ আর অন্য পিঠার দাম ২০ থেকে ৪০ টাকার মধ্যে৷
যে চার ধরনের পিঠার চাহিদা সবচেয়ে বেশি
ঢাকায় চার ধরনের পিঠার চাহিদা সবচেয়ে বেশি৷ এগুলো হলো ভাপা, চিতই, পাটিসাপটা এবং পোয়া৷ এই পিঠাগুলো সুস্বাদু এবং এগুলো সংরক্ষণ করাও সহজ৷
পিঠার কারিগর
বাংলাদেশে পিঠা তৈরি প্রশিক্ষণ দেয়ার কোনো প্রতিষ্ঠান নেই৷ সবাই দেখতে দেখতেই শেখেন৷ এটা নিয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কেউ কেউ পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করেন৷ তাঁদেরই একজন বেইলি পিঠাঘরের মোহাম্মদ বাসান৷ তিনি ১৫ বছর ধরে এখানে পিঠা তৈরি করছেন৷ তাঁর সঙ্গে কাজ করেন আরো ১২ জন৷
ফাস্টফুড ও মিষ্টির দোকানেও পিঠা
এখন ফাস্টফুড আর মিষ্টির দোকানে ১২ মাসই পাটিসাপটা পিঠা পাওয়া যায়৷ তবে শীতকালে অভিজাত কিছু দোকানে আয়োজন করে পিঠা বিক্রি হয়৷ চিতই, ভাপা ছাড়াও পুলি, পাক্কন পাওয়া যায় সেখানে৷
সবই কি স্বাস্থ্যসম্মত?
সড়কের পাশের অথবা অভিজাত দোকানের পিঠা বিক্রেতা- সবারই দাবি তাঁর দোকানের পিঠা স্বাস্থ্যসম্মত৷ কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি সব ক্ষেত্রে তা বলে না৷ পিঠার মান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাও নেই বিআইএটিএ’র৷
পিঠার সাজ
পিঠা তৈরির জন্য নানা ধরনের সাজের প্রয়োজন হয়৷ ঢাকার বিভিন্ন মার্কেট ও কাঁচাবাজারে ভাপা ও চিতই পিঠার মাটির সাজ পাওয়া যায়৷ দাম ৪০ থেকে ৮০ টাকা৷ নকশি পিঠার প্লাস্টিকের সাজও পাওয় যায় বাজারে৷ এসব সাজ দিয়ে ঘরে বসেই বানাতে পারেন পিঠা৷
আতপ চালের রকমভেদ
পিঠার প্রধান উপাদান আতপ চাল৷ যে চাল সিদ্ধ না করে সরাসরি শুকানো হয়, তা-ই আতপ চাল৷ এর দাম কেজিপ্রতি ৪০ থেকে ১২০ টাকা৷ চিতই আর ভাপা তৈরি হয় সাধারণ আতপ চালে৷ আর নকশি পিঠা চিনিগুঁড়া চালে৷
যে গুড়ে পিঠা হয়
চাল ছাড়াও পিঠার অন্যতম উপাদান হলো গুড়, চিনি ও দুধ৷ এই গুড় কিনতে হবে বুঝেশুনে৷ ঢাকার কৃষি মার্কেটসহ আরো কয়েকটি মার্কেটে যশোর এবং রাজশাহীর ভালো মানের খেজুরের গুড় পাওয়া যায়৷ দাম প্রতি কেজি ১২০ থেকে ১৫০ টাকা৷
পিঠার নারকেল
পিঠার স্বাদ বাড়ায় নারকেল৷ বিশেষ করে জনপ্রিয় ভাপা পিঠা তো নারকেল ছাড়া হবেই না৷ বরিশাল, খুলনার ভালো নারকেল পাবেন কারওয়ান বাজার ও কৃষি মার্কেটে৷ তবে এই নারকেল ফাটানো ও কোরানো এক ঝক্কির বিষয়৷
অনলাইনে পিঠা
এখন ঢাকায় অনলাইনে অর্ডার করেও পিঠা পেতে পারেন৷ এরকম প্রচুর অনলাইন শপ গড়ে উঠেছে৷ সাধারণভাবে দুধ চিতই আর চুই পিঠা দোকানে পাওয় যায় না৷ তবে অনলাইনে পাওয়া যায়৷
পিঠা উৎসব
ঢাকা ও ঢাকার বাইরে শীতে আয়োজন করা হয় পিঠা উৎসব আর পিঠা মেলার৷ কোনোটি বড় আবার কোনোটি ঘরোয়া পরিবেশে৷ শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গনে জাতীয় পিঠা উৎসব পিঠার সবচেয়ে বড় আয়োজন৷ শুরু হয় ২০ জানুয়ারি৷ এরইমধ্যে ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি আয়েজন করেছিল পিঠা উৎসবের৷
রাস্তার পাশে পিঠা বিক্রি করে ঢাকায় তিন তলা বাড়ি
হানিফ হাওলাদার ভাগ্যের টানে ঢাকায় আসেন ১২ বছর বয়সে৷ এখন বয়স প্রায় ৫০৷ তিনি চার সন্তানের জনক৷ ৩৫ বছর ধরে ঢাকার জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডে চিতই পিঠা বিক্রি করছেন৷ আর এই পিঠা বিক্রির টাকায় সংসার চালিয়ে, সন্তানদের পড়াশোনা করিয়ে ঢাকার কামরাঙ্গির চরে করেছেন তিন তলা পাকা বাড়ি৷ তার চিতই পিঠার সুখ্যাতি পুরো এলাকা জুড়ে৷ প্রতিদিন গড়ে আয় করেন ৩ হাজার টাকা৷