পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা পরিবর্তনে মেয়েদের শক্ত হতে হবে: ফারজানা
১৬ নভেম্বর ২০১১দৃঢ়চিত্ত এই তরুণীকে আজ বাহবা দিচ্ছেন বন্ধু, প্রতিবেশী থেকে শুরু করে প্রশাসন, রাষ্ট্র, দেশ, এমনকি সাধারণ মানুষও৷ যৌতুকের দাবি করায়, স্বামী শওকত আলী খান হিরণের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছেন তিনি৷ জানা গেছে, বর শওকত আলী খান হিরণ এবং তাঁর ফুপু শিক্ষিকা তাহমিনা খানমের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে৷
ঘটনাটা গত শুক্রবারের৷ সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে গেলেও, বিয়ে বাড়ির আলোর রোশনাই তখনও নিভে যায় নি৷ মেয়েকে বরের হাতে তুলে দিতে গিয়ে বাধ সাধলেন হিরণের ফুপু তাহমিনা বেগম৷ নিপা জানান, ‘‘বিয়ের আগে বরপক্ষের কোনো দাবি-দাওয়া ছিল না৷ অথচ বিয়ের উপহার সামগ্রীর জন্য হঠাৎ করেই হট্টগোল শুরু করে দেন তাহমিনা৷ বলেন, রঙিন টেলিভিশন, ফ্রিজ আর মোটরসাইকেল না দিলে মেয়েকে তাঁরা পাঁচ বছর ঝুলিয়ে রাখবেন৷''
ফুপুর এ কথায় হতবাক হয়ে যান ফারজানা ইয়াসমিন নিপা৷ সদ্য বিয়ে করা বরও যখন ফুপুর দাবিকে সমর্থন করেন, তখন হিরণকে তক্ষুনি তালাক দেন নিপা৷ গহনা খুলে উঠে যান বিয়ের আসর থেকে৷ নিপার ভাষায়, ‘‘আমি একজন উচ্চশিক্ষিত মেয়ে, কেন পণ দিয়ে বিয়ে করবো?''
সন্ধ্যার পর বরপক্ষ সমঝোতা করে কনেকে নিয়ে যেতে চাইলেও রাজি হননি নিপা৷ বরং একদিন পরই ফিরে আসেন ঢাকায়৷ তিনি জানান, ‘‘এক্ষেত্রে সমঝোতার কোনো অবকাশই নেই৷ যারা মানুষের সততাকে দুর্বলতা মনে করে, সেসব মুখোশধারী মানুষের মুখোশ সমাজের সামনে এভাবেই খুলে দেওয়া জরুরি৷ আমার মনে হয়, কোনো মেয়েরই যৌতুক দিয়ে বিয়ে করা উচিত নয়৷ একজন শিক্ষক, যিনি মানুষ তৈরি করেন, ভালো-মন্দের ভেদাভেদ শেখান, তিনি নিজের বিয়েতে কীভাবে যৌতুক দাবি করেন - তা আমি বুঝতে পারি না৷''
ডয়চে ভেলেকে ফারজানা বলেন, ‘‘ভালো করেছি কি না, জানি না৷ তবে মন্দ কিছু যে করিনি – তা বুঝতে পারছি৷'' নিপা জানান, ‘‘আসলে পুরো পরিবারটিই ছিল লোভী৷ ওরা ভেবেছিল যৌতুক না চাইলেও উপহার হিসেবে তাঁদের ধনী বানিয়ে দেবেন আমার বাবা৷ আর বিয়ে হয়ে গেলে যৌতুক দিতে বাধ্য হবো আমরা৷''
স্বাভাবিকভাবেই, ইডেন কলেজের সমাজকল্যাণ বিভাগে প্রথম শ্রেণীতে মাস্টার্স নিয়ে পাস করা ফারজানা ইয়াসমিন নিপা এভাবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বাংলাদেশের শত শত মেয়ের সামনে৷ নিপার বাবা খলিলুর রহমান পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের একজন ইন্সপেক্টর, মা সুরাইয়া বেগম গৃহিণী৷ এছাড়া, চার বোন এক ভাইয়ের মধ্যে নিপা তৃতীয়৷ তিনি জানান, ‘‘আমার অন্য কোনো বোনের বিয়েতেও কিন্তু যৌতুক দেওয়া হয় নি৷ তাই বুঝিয়ে বলার পর, এ সিদ্ধান্তকে আমার বাবা-মা – দু'জনেই সমর্থন করেন৷ আশা করছি শীঘ্রই আইনত বিবাহবিচ্ছেদও হয়ে যাবে আমার৷''
জানা যায়, ঐ ঘটনার পর জেলা প্রশাসকসহ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা নিপাকে শুভেচ্ছা জানান৷ অভিনন্দন জানানো হয় বিভিন্ন নারী এবং মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে৷ এমনকি মঙ্গলবার, সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীও নিপাকে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য আমন্ত্রণ জানান৷
ভবিষ্যতে নিজেকে কিভাবে দেখতে চান আপনি? এ প্রশ্নের জবাবে ফারজানার উত্তর: ‘‘সব কিছু ভুলে, একজন সফল মানুষ হিসেবে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই আমি৷ ভালো চাকরি করে নিজেকে আরো প্রতিষ্ঠিত করতে চাই৷ কাজ করতে চাই সমাজের দুস্থ, অসহায় ও গরিব নারীর কল্যাণে৷''
সাহসী এই তরুণীর কথায়, ‘‘মেয়েরা বহু দিন ধরে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যৌতুকের বলি হয়ে আসছে৷ এ অবস্থার পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন৷ আর তার জন্য পুরুষদের সচেতনতার পাশাপাশি প্রতিটি মেয়েকে আরো শক্ত হতে হবে৷''
প্রতিবেদন: দেবারতি গুহ
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক