পুলিশি নির্দেশিকায় ক্ষোভ
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪কিছু কিছু নির্দেশ শুনলে মনে হতে পারে চিন্তাভাবনায় রক্ষণশীল কোনো কট্টরবাদী গোষ্ঠী, বা মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণা মেনে চলা কোনো খাপ পঞ্চায়েতের দেওয়া ফতোয়া! কিন্তু না, পথচলতি মহিলাদের নিরাপত্তা সুরক্ষিত রাখতে এই বিধান কলকাতার সল্ট লেক বা বিধাননগরের পুলিশের৷
মোট এক ডজন নির্দেশিকা – ১৷ শোভন পোশাক পরুন, ২৷ মোবাইল ফোনে জরুরি স্পিড ডায়াল নাম্বার সেভ করে রাখুন, ৩৷ আত্মরক্ষার কৌশল (শিখুন), ৪৷ নিজের চারপাশের লোকজন সম্পর্কে সজাগ থাকুন, ৫৷ বেশি রাত পর্যন্ত বাইরে থাকা এড়িয়ে চলুন, ৬৷ পেপার স্প্রে সঙ্গে রাখুন, ৭৷ ব্যবহারে শালীনতা বজায় রাখুন, ৮৷ দল বেঁধে থাকুন, ৯৷ ভিড় বাস বা ট্রেনে যাতায়াত এড়িয়ে চলুন , ১০৷ নির্জন জায়গা এড়িয়ে চলুন, ১১৷ আলোকিত এবং জনবহুল এলাকায় থাকুন এবং ১২৷ স্ট্রিট স্মার্ট হোন৷
বিধাননগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার নবনিযুক্ত ডেপুটি কমিশনার, আইপিএস কঙ্কর বারুই, যাঁর সই ‘ইভ টিজিং এড়াতে পরামর্শ' শিরোনামের এই নির্দেশিকার নীচে ছিল, তিনি নিঃসন্দেহে মেয়েদের সতর্ক করার সদুদ্দেশেই এই পরামর্শ দিয়েছিলেন৷ পরে সংবাদমাধ্যমের সমালোচনার জবাবে তিনি সেটি সমর্থনও করেন এই বলে যে, যেখানে যেমনভাবে চলা দরকার, তিনি ঠিক সেই পরামর্শই দিয়েছেন৷ যদিও পরে জমনানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখে বিধাননগর পুলিশের ওয়েবসাইট থেকে নির্দেশিকাটি সরিয়ে নেওয়া হয়৷ কিন্তু তার পরেও প্রশ্ন উঠছে, যেখানে নারীদের যৌন নিগ্রহ রুখতে খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে মায়েদের প্রতি আবেদন রাখছেন তাঁদের ছেলেদের সুস্থ মানসিকতা গড়ে তোলার, সেখানে এক পুলিশকর্তা কীভাবে ইভটিজিংয়ের দায় চাপিয়ে দিতে পারেন মেয়েদের পোশাক বা আচার-ব্যবহারের ওপর!
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর ওই ভাষণে বলেছিলেন, মায়েদেরই খেয়াল রাখতে হবে যাতে তাঁদের ছেলেরা এমনভাবে মানুষ হয় যে, মেয়েদের খারাপ চোখে না দেখে৷ কিন্তু বিধাননগরের পুলিশ কর্তা বললেন তার ঠিক উল্টো কথা! তাছাড়া অনেক মহিলাই ওই নির্দেশিকার মধ্যে স্ববিরোধিতা খুঁজে পাচ্ছেন৷ সল্ট লেকের বাসিন্দা, পেশায় শিক্ষিকা নিনা সেনগুপ্তকে রোজই সল্ট লেকের রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করতে হয়৷ তাঁর অভিজ্ঞতা, অনেক সময় রাস্তায় আলো থাকে না, কখনও রিক্স বা অটোরিক্স না থাকলে ভিড় বাসেও উঠতে হয়৷ তাঁর বিস্মিত প্রশ্ন, তা হলে কি পরোক্ষে সল্ট লেকের মেয়েদের বাড়ি বসে থাকারই উপদেশ দিচ্ছেন পুলিশকর্তা, যাঁর হাতে আইনরক্ষার ভার!
কলেজছাত্রী হংসা রুংতা একটা সময় নিয়মিত সল্ট লেকে টিউশন পড়তে আসতেন৷ এই তরুণীর প্রতিক্রিয়া আরও তীব্র৷ তিনি বলছেন, পুলিস ভিড় বাসে উঠতে বারণ করছে৷ খুব ভালো কথা৷ তা হলে সমস্ত মেয়েকে একটা করে গাড়ি কিনে দেওয়া হোক, যাতে তারা নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারে! অথবা পুলিশের উদ্যোগে মেয়েদের জন্যে কার পুল চালু করা হোক৷ কারণ, মেয়েদেরও ভালো লাগে না ভিড় বাসে বা ট্রেনে উঠতে, লোকের ধাক্কা আর নোংরা স্পর্শ পেতে৷ কিন্তু আজ ট্যাক্সি ধর্মঘট, কাল অটোরিক্স স্ট্রাইক – ফলে মেয়েদের বাধ্য হয়েই ভিড় বাসে উঠতে হয়৷ আর বাস খালি পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করলে তখন আবার রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যাবে৷ পুলিশ তো ফাঁকা জায়গাতে যেতেও বারণ করেছে, কটাক্ষ হংসার৷
তবে মহিলাদের অনেকেই গোটা বিষয়টির মধ্যে পুলিশের দায়িত্ব এড়ানোর মানসিকতা লক্ষ্য করছেন৷ ঠিক যেভাবে ‘মেয়েটি অত রাতে ওখানে কী করছিল?', বা ‘মেয়েদের অমন পোশাক পরার দরকার কী?' ধরনের মন্তব্য শোনা যায় কোনো নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটলেই৷ ঠিক যেভাবে নিগৃহিতা মেয়ের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলে অপরাধকে স্বাভাবিক করে দেখানোর অপচেষ্টা হয়৷ নানা ধরনের সামাজিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকেন দিয়া ঘোষ৷ তিনি প্রশ্ন তুললেন, পুলিশ যে বলছে শোভন পোশাক পরতে বা শালীন ব্যবহার করতে, কোনটা শোভন, কোনটা শালীন – সেটা কে ঠিক করে দেবে! নাকি এবার থেকে প্রশাসনই ঠিক করে দেবে মেয়েদের জন্যে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল!
চাপে পড়ে বিতর্কিত নির্দেশিকাটি চুপচাপ সরিয়ে ফেলেছে বিধাননগর পুলিশ, কিন্তু বিতর্ক এখনও থামেনি৷ প্রশ্ন উঠছেই, সমাজ নিজেকে সংশোধন করবে না, প্রশাসন নিজের কাজ করবে না, মেয়েদের সম্মানরক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে একা মেয়েদেরই!