1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পুলিশ, ওরে পুলিশ, 'ছাত্র' দেখলে টুপিটা তোর খুলিস

২১ জানুয়ারি ২০২২

উপাচার্য অথবা কলেজের অধ্যক্ষ অনুমতি না দিলে ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢুকতে পারে না৷ এটাই ভারতের আইন৷ বাকি প্রশ্ন কর্তৃপক্ষের শিরদাঁড়ার৷ 

https://p.dw.com/p/45tId
বাংলাদেশের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আমরণ অনশনে এক শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে
বাংলাদেশের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আমরণ অনশনে এক শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছেছবি: Mohammad Rafayat Haque Khan/DW

২০০৩-০৪ সালের কথা৷ কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রদের একাংশের সঙ্গে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে কর্তৃপক্ষের৷ মূলত প্রিন্সিপালের৷ তখনো বিশ্ববিদ্যালয় হয়নি প্রেসিডেন্সি৷ ১৮১৭ সালে তৈরি হওয়া কলেজের কাঠামোই চলমান-বর্তমান৷ ছাত্রদের চার প্রতিনিধি সটান হাজির অধ্যক্ষের ঘরে৷ সব কাজ ফেলে অধ্যক্ষকে তখনই বৈঠক করতে হবে৷ ছাত্রদের মূল দাবি গ্রন্থাগারের ডিজিটাল সংস্কার৷ অধ্যক্ষের বক্তব্য, রাতারাতি এ কাজ সম্ভব নয়৷ আর তা নিয়েই বচসা৷ শেষমেশ ছাত্ররা ঠিক করল, অধ্যক্ষ এবং টিচার্স কাউন্সিলকে ঘেরাও করা হবে৷ যেমন ভাবনা তেমন কাজ৷ দিনদুয়েক ঘেরাও থাকার পর রফা মীমাংসা যখন হলো, অধ্যক্ষের শরীর তখন বেশ খারাপ৷ কলেজ থেকে হাসপাতালে পাঠাতে হয়েছিল তাকে৷ ঘেরাও করে রাখা ছাত্ররা ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করছে কি না সেই চিন্তায় তিনি নিজেও দুইদিন কার্যত উপোস করে ছিলেন৷ টিচার্স কাউন্সিলের কোনো কোনো অধ্যাপক পুলিশ ডাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন অধ্যক্ষকে৷ কড়া ধমকে তাদের থামিয়ে দিয়েছিলেন প্রিন্সিপাল মহোদয়৷

এর ঠিক দেড় বছর পরের কথা৷ সাপ্লিমেন্টারি টেস্ট নিয়ে কোনো এক সমস্যার জেরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে হরতালে বসে ছাত্ররা৷ প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে ক্লাস বয়কট করে দাবি আদায়ের আন্দোলন চলতে থাকে৷ মূল এজেন্ডার সঙ্গে আরো বেশ কিছু বিষয় জুড়ে যায়৷ ২০০৬ সালে যাদবপুরের ওই আন্দোলন রীতিমতো আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে সংবাদ মাধ্যমে৷ এমনই এক রাতে আচমকাই শয়ে শয়ে পুলিশ ঢোকে ক্যাম্পাসের ভিতর৷ অনশনরত ছাত্রদের বেধড়ক পিটিয়ে, কার্যত আধমরা করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়৷ বাকি ঘটনা ইতিহাস৷ কলকাতার বিশিষ্টজন থেকে দলমত নির্বিশেষে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব-- রাস্তায় নেমে পড়েছিলেন সকলে৷ বিশাল মিছিলে স্লোগান উঠেছিল-- 'লাঠির মুখে গানের সুর, দেখিয়ে দিল যাদবপুর'৷ উঠেছিল আরো একটি স্লোগান৷ সত্তর দশকের উত্তাল ছাত্র রাজনীতির আমলে এক কবির লেখা অসামান্য এক লাইন-- 'পুলিশ, ওরে পুলিশ, কবি দেখলে টুপিটা তোর খুলিস৷' কোন আক্কেলে উপাচার্য ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢোকার নির্দেশ দিলেন, তা নিয়ে সে সময় রীতিমতো জবাবদিহি করতে হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে৷ শুধু সরকারের কাছে নয়, সমাজের কাছেও৷

ভারতের অধিকাংশ রাজ্যে সরকারি কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম খুব পরিষ্কার৷ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢুকতে পারবে না৷ যত বড় ঘটনাই ঘটে যাক, উপাচার্য বা অধ্যক্ষ সম্মতি দিলে তবেই পুলিশ গেটের ভিতর ঢুকতে পারবে৷ একসময় উপাচার্য, অধ্যক্ষরা এই নিয়মটিকে গরিমা হিসেবে দেখতেন৷ 

চাকরি পাওয়ার পরে সেদিন আন্দোলনরত ছাত্রদের একজন প্রেসিডেন্সি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করতে গেছিল৷ ঘটনার অন্তত বছর পাঁচেক পরে৷ মাথায় হাত রেখে অধ্যক্ষ বলেছিলেন, ''তোমরা কেবল ছাত্র নও৷ সন্তান৷ আমাদের শিক্ষকেরাও সেভাবেই বড় করেছেন আমাদের৷'' নিজের কলেজ, নিজের ছাত্রদের প্রতি এই দায়বদ্ধতা যাদের আছে, তারা কি কখনো পুলিশের লাঠির সামনে সন্তানদের ঠেলে দিতে পারেন? যাদবপুরের ঘটনার পর একাধিক সাবেক উপাচার্য সেই প্রশ্নই তুলেছিলেন৷ 

স্যমন্তক ঘোষ, ডয়চে ভেলে
স্যমন্তক ঘোষ, ডয়চে ভেলেছবি: privat

সময় বদলেছে৷ রাজনীতির রঙ বদলেছে৷ সমাজে বেড়েছে অসহিষ্ণুতা৷ সেদিন যা ব্যতিক্রম ছিল, আজ সেটাই নিয়ম৷ বছরখানেক আগে দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা ভারতের ইতিহাসে কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত থাকবে৷ রাতের অন্ধকারে কোনো প্ররোচনা ছাড়া সশস্ত্র পুলিশ ঢুকে পড়েছিল ক্যাম্পাসের ভিতর৷ ক্লাসরুম থেকে হস্টেল-- তছনছ করে দিয়েছিল পুলিশ৷ ছাত্রদের পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল৷ দেশ জুড়ে তখন সিএএ বিরোধী আন্দোলন চলছে৷ জামিয়ার ছাত্ররাও তাতে অংশ নিয়েছিল৷ তাই এত আক্রোশ৷ ওই ঘটনায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ দিল্লি পুলিশের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল৷ প্রশ্ন উঠেছিল উপাচার্যের অবস্থান নিয়েও৷ উপাচার্য নির্দেশ না দিলে যে পুলিশ কখনোই ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারে না, সে কথা নতুন করে সামনে এসেছিল৷ কিন্তু উপাচার্যকে সমাজের সামনে কৈফিয়ত দিতে হয়নি৷ এর কিছুদিনের মধ্যে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে আরো এক গোলমালের ঘটনা ঘটে৷ সেই ঘটনায় কিন্তু পুলিশকে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি৷ বহিরাগতরা ক্যাম্পাসে ঢুকে হারাকিরি চালালেও পুলিশ ছিল নীরব দর্শক৷ বহিরাগতদের আটকাতে পুলিশকে কেন সেদিন ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেওয়া হলো না, গোটা দেশে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল৷ সেও এক কলঙ্কের ইতিহাস৷

আর বিশ্বভারতী? শান্তিনিকেতনে রবিঠাকুরের বিশ্বভারতীর কথা যত কম বলা যায়, ততই ভালো৷ ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢোকা সেখানে কার্যত নিত্যদিনের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ ছাত্রদের সন্তান নয়, কার্যত 'অপরাধী'র সঙ্গে তুলনা করেন সেখানকার বর্তমান উপাচার্য৷ কথায় কথায় ছাত্রদের রাজনৈতিক রং নিয়ে প্রশ্ন তোলেন৷

পুনশ্চ: এই লেখা লেখার সময় প্রেসিডেন্সি কলেজের সেই সাবেক অধ্যক্ষকে ফোন করেছিল ছাত্র৷ একটি উদ্ধৃতি নেওয়ার জন্য৷ বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর জবাব দিলেন: ''বিস্মিত লাগে৷ ক্যাম্পাসগুলো কেমন যেন চোর-পুলিশ খেলার ময়দানে পরিণত হয়েছে৷ এমন দিনও যে দেখতে হবে ভাবিনি৷ এবার ভালোয় ভালোয় চলে যাওয়াই ভালো৷''