জুনেরা যেভাবে যৌনকর্মী
১৫ জুলাই ২০১৪অবর্ণনীয় অত্যাচার সহ্য করে অবশেষে পালাতে পারলেও মৃত্যু আতঙ্ক এখনো তাড়া করছে তাঁকে৷
ফয়সালাবাদের মেয়ে জুনেরা৷ শৈশবে স্বপ্ন ছিল প্রকৌশলী হওয়ার৷ কিন্তু পরিবারের দুরবস্থা তাঁর আর বোন শাইস্তার জীবনে এনেছে দুর্বিসহ কষ্ট৷ দুই বোনের জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে পূর্ণ নাম এবং ঠিকানা গোপন রেখে বার্তা সংস্থা এএফপি প্রকাশ করেছে এমন এক প্রতিবেদন, যা পড়ে যে-কোনো স্বাভাবিক মানুষের হৃদয় কাঁদবে৷ এলাকার আয়েশা নামের এক নারী জুনেরার পরিবারের দুঃসময়ে এগিয়ে এসেছিলেন সহানুভূতিশীল হিতার্থীর ছদ্মাবরণে৷ প্রথমে দেয়া হয় স্থানীয় কোনো বাসায় কাজ করার প্রস্তাব৷ জুনেরা আর শাইস্তার তাতে আপত্তি ছিলনা৷
তারপরই আসে দুবাই গিয়ে ভালো কাজ করে রাতারাতি পারিবারিক দৈন্য দূর করার প্রলোভন৷ দু-বোনের কারো বয়সই তখনো ১৮ হয়নি৷ অর্থাৎ দুজনই অপ্রাপ্ত বয়স্ক৷ আয়েশা জাল কাগজপত্র করে সেই সমস্যা সমাধান করে নিয়ে গেলেন দুবাই৷ দুবাই বিমানবন্দরের শৌচাগারে নিয়ে ছলচাতুরীতে পারদর্শী আয়েশা জানিয়ে দেয়, জুনেরা আর শাইস্তাকে শুরু করতে হবে নতুন জীবন৷ সে এমন এক জীবন যা যাপনের কথা কোনোদিন দুঃস্বপ্নেও দেখেনি দু-বোন৷ দেহ দিয়ে খদ্দের খুশি করার প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় দেয়া হয় জাল কাগজপত্রসহ পুলিশে ধরিয়ে দেয়ার হুমকি৷ পরিবার-পরিজন ছেড়ে অচেনা দেশে পাড়ি জমানো মেয়ে দুটি তখন আর রাজি না হয়ে পারেনি৷
সেদিন থেকেই শুরু ‘নিষিদ্ধ পল্লী'তে জুনেরা আর শাইস্তার বসবাস৷ প্রথম দিন শাইস্তাকে সামনে রেখে আয়শা নিজে দাঁড়িয়ে ধর্ষণ করায় জুনেরাকে৷ দ্বিতীয় দিন থেকে আয়শা আর কাছে থাকতো না৷ খদ্দেরকে বলে যেতো, যৌনকর্মের সময় মোবাইল ফোন চালু রাখতে, যাতে দুই বোনের একজনও কথামতো কাজ করতে আপত্তি জানালে সঙ্গে সঙ্গেই কঠোর ব্যবস্থা নেয়া যায়৷ কঠোর ব্যবস্থা মানে অকথ্য শারীরিক নির্যাতন৷ জুনেরা আর শাইস্তার সারা শরীরে এখনো আছে সেসবের চিহ্ন৷
চার বছর অবমাননাকর অমানবিক জীবনযাপনের পর ২০১৩ সালে লুকিয়ে দেশে ফিরেছেন জুনেরা আর শাইস্তা৷ আগের চার বছরে কয়েকবার দেশে আসার সুযোগ পেয়েছিল তারা৷ আয়শাই নিয়ে এসেছিল সব কাগজপত্র হালনাগাদ করাতে৷ মা-বাবার কাছে পৌঁছে দেবার সময় আয়শা বলে যেতো, ‘‘দুবাইতে কী করিস তা ভুলেও বলবিনা৷ বললেই মেরে ফেলবো৷''
প্রাণভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারতো না ফয়সালাবাদের সাধারণ পরিবারের দুটি মেয়ে৷ অত্যাচার সহ্য করতে করতে একসময় সহ্যের সীমা অতিক্রম করায় দু-বোনই সব খুলে বলল বড় বোন কামারকে৷ কামারের সাহসী পদক্ষেপের কারণেই জুনেরা আর শাইস্তা এখন পাকিস্তানে৷ তবে স্বদেশেও জীবন মোটেই সুখের হয়নি৷ আয়শার নারী পাচার চক্রকে বিচারের মুখোমুখি করতে পুলিশের শরণাপন্ন হয়েছিলেন কামার৷ কয়েকদিনের মধ্যেই আয়শার এক ভাই এসে তিনটি গুলি করে জুনেরার পায়ে৷ গুলি করে সদর্পে ফিরে যায় আয়শার ভাই৷
হাসপাতালে নিয়ে জুনেরার পায়ে অস্ত্রোপচার করানো হয়৷ তারপরও থামেনি অত্যাচার৷ এবার স্থানীয় পুলিশ নামে জুনেরাকে অপদস্থ করার কাজে৷ হাসপাতালে সদ্য অস্ত্রোপচার করানো পা নিয়েই জুনেরাকে হেঁটে দেখাতে বলে পুলিশ৷ অতি কষ্টে হেঁটে দেখিয়েছিলেন ঠিকই, তবে তারপর আর হাসপাতালে থাকা হয়নি৷ হাসপাতাল ছাড়ার পর থেকেই জুনেরার পরিবার এলাকাছাড়া৷ প্রাণভয়ে এলাকা ছাড়লেও আর কোনো মেয়েকে যেন তাদের মতো দুর্ভাগ্য বরণ করতে না হয় সেজন্য আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন আয়শার বিরুদ্ধে৷ সে লড়াই কবে শেষ হবে কে জানে! জুনেরা আর শাইস্তার আইনজীবী জুলফিকার আলী ভুট্টা বললেন, ‘‘এ মামলার প্রধান আসামী (আয়শার স্বামী) আশফাক৷ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সামনেই আদালত থেকে পালিয়েছে সে৷ আদালত জামিন বাতিল করা সত্ত্বেও তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি৷''
এসিবি/জেডএইচ (এএফপি)