প্রশ্নফাঁস তো সাধারণ ঘটনা, হয়েই থাকে
১৮ আগস্ট ২০২৩ভারতে প্রশ্নফাঁস নিয়ে কেউ আর অবাক হন না। কোন পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হয়নি? মধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, নিয়োগ-পরীক্ষা? সর্বত্র দুর্নীতি ও প্রশ্নফাঁস এখন গা-সহা হয়ে গেছে। আমরা জেনে গেছি, এসব হয়, হয়েই থাকে।
পশ্চিমবঙ্গে এবারের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার কথা ধরুন। দুটোতেই প্রশ্নফাঁস হয়েছে। মাধ্যমিকের ইংরাজি ও উচ্চ মাধ্যমিকের জীবনবিজ্ঞান। পরীক্ষা চলছে, তখনই মানুষের মোবাইলে ঘুরছে প্রশ্নপত্র। সেটাকে ঢাল করে পর্ষদ কর্তারা বলেছেন, পরীক্ষা শুরুর পর ফাঁস হলে কী এসে যায়।
পর্যদ কর্তারা দায় এড়ানোর জন্য যাই বলুন না কেন, সেই প্রশ্নপত্র কতটা আগে ফাঁস হয়েছিল তা কে বলবে? আর দ্বিতীয় কথা হলো, প্রশ্নপত্র ফাঁস হবেই বা কেন?
ডিএলএড পরীক্ষার ক্ষেত্রে তো এই অজুহাত দেয়ারও কোনো উপায় নেই। গতবছর এই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সাড়ে দশটা নাগাদ হোয়াটস অ্যাপে ঘুরতে থাকে। পরীক্ষা ছিল বারোটায়। এরপর পর্ষদ সভাপতি বলেন, সরকারকে বদনাম করতে এই কাজ করা হয়েছে কি না দেখতে হবে। তারা বিষয়টি তদন্ত করবেন।
এই তদন্ত করা বিষয়টি খুব গোলমেলে। যেহেতু সাধারণ মানুষের স্মৃতি দীর্ঘস্থায়ী হয় না, যেহেতু সংবাদমাধ্যম নতুন নতুন বিষয় নিয়ে মেতে ওঠে, তাই এই তদন্ত কবে হয়, কীভাবে হয়, তার ফল কী হয়, কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় কি না, কিছুই জানা যায় না।
আর প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের জন্য টেট পরীক্ষার প্রশ্ন তো বারবার ফাঁস হয়েছে। সেটাও সাবেক মন্ত্রী মানিক ভট্টাচার্য জানতেন বলে অভিযোগ। সংবাদপত্রের রিপোর্ট বলছে, কলকাতা এই রিপোর্ঠ ফাঁসের মূলকেন্দ্র ছিল। আর জেলায় কিছু টিউটোরিয়াল সেন্টার এই কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ইডি এখন তা তদন্ত করে দেখছে।
পশ্চিমবঙ্গে নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে সিবিআই কলকাতা হাইকোর্টে যা বলেছে, তাতে তো সব রেকর্ড ভেঙে গেছে। পরীক্ষায় দুর্নীতি নতুন পর্যায়ে চলে গেছে। এখন আর প্রশ্ন আগে থেকে জেনে পরীক্ষাকেন্দ্রে লেখারও দরকার নেই, গার্ডকে ভয় পাওয়ারও দরকার নেই। যথাস্থানে লাখ লাখ টাকা দিয়ে দিলেই হলো। তারপর পরীক্ষায় সাদা খাতা জমা দিলেও দেখা যাবে, সেই পরীক্ষার্থীর নাম তালিকায় উপরে আছে এবং সেই চাকরি পাচ্ছে।
এবার য়ে কাহিনিটা বলবো সেটা আমার শোনা। সত্যমিথ্যা যাচাই করতে পারিনি। তবে শুনে একবারও মনে হয়নি, এটা সত্যি নয়। শিক্ষকদের যোগ্যতামান পেরোনোর পরীক্ষা হয়েছে। তারপর নিয়মমতো সব উত্তরপত্র নিয়ে দপ্তরে পৌঁছাতে গিয়েছেন এক অধিকারী। সেখানে যার কাছে তা জমা দেয়ার কথা, তার কাছে কিছু রোলনম্বর ছিল। তিনি সেই রোলনম্বর মিলিয়ে খাতা বের করে, বাকি বান্ডিল ফেলে দিলেন। সেগুলো চেক করারও দরকার নেই। এভাবেই দুর্নীতি করে ছাত্রছাত্রীদের চাকরি পাওয়ার পথ বন্ধ করে দিলেন তারা।
শিক্ষা দুর্নীতির আরেক রূপ ব্যাপক কেলেঙ্কারি। সেখানে পরীক্ষার্থীকে হলে গিয়ে কষ্ট করে লিখতেও হত না। সেখানে টাকা দিলেই মূল পরীক্ষার্থীর জায়গায় অন্য কেউ গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসত। সে যা উত্তর দেবে, তাতে পাস করা নিশ্চিত। শুধু তাই নয়, এর সঙ্গে প্রশ্নফাঁসও থাকত। মূল পরীক্ষার্থীর জায়গায় যে পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিতেন, তার কাছে আগে থেকেই কী প্রশ্ন আসবে তা জানিয়ে দেয়া হত। মূল অ্যাডমিট কার্ডের ছবি বদলে দেয়া হত।
এতসব কাণ্ডের পরেও যদি দরকার হয়. তাহলে নম্বর বাড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা থাকত। এরপর আর কী বলবেন? এখন পরীক্ষা ক্ষেত্রে দুর্নীতির এত রূপ দেখে ফেলেছি আমরা যে আর অবাকও হই না। মনে রাখবেন, ব্যাপমের মাধ্যমে পরীক্ষা দিয়ে বিভিন্ন শাখায় ভর্তি হওয়া যেত, চাকরির পরীক্ষায় পাস করে চাকরি পাওয়া যেত। ফলে কোন মাত্রায় দুর্নীতি হয়েছিল, তা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন।
অভিযোগ, এর সঙ্গে মধ্য়প্রদেশের উচ্চ পর্যায়ের রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী, মাফিয়া, টিউটোরিয়াল সেন্টার, দালাল, বাহবলী সকলেই জড়িত ছিল। এরপর শুধু একটা তথ্য দেয়াই যথেষ্ট, তা হলো, ব্যাপমের সঙ্গে জড়িত বা বিরোধিতা করা ৪৩ জনের রহস্যমৃত্যু হয়েছে।
তবে শুধু পশ্চিমবঙ্গ ও মধ্যপ্রদেশে প্রশ্নফাঁস বা অন্য দুর্নীতি হয়েছে এমন নয়। রিপোর্ট বলছে, সাত বছরে দেশে মোট ৭০টি প্রশ্নফাঁস হয়েছে। দেড় কোটিরও বেশি পড়ুয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রশ্নফাঁসের শেষতম কেলেঙ্কারি হয়েছে তেলেঙ্গানায়। সেখানে সম্প্রতি টাউন প্ল্যানিং ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস হয়। যার জেরে পরীক্ষা বাতিল হয়।
আসামে তো গত মার্চে মাধ্যমিকের প্রশ্নফাঁস হয়েছে। দুইশ থেকে তিন হাজার টাকায় প্রশ্ন পাওয়া গেছে বলে অভিযোগ। বিহারে সাত বছরে ছয়বার ও পশ্চিমবঙ্গে দশবার প্রশ্নফাঁস হয়েছে। তামিলনাড়ুতে ২০২২ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের প্রশ্নফাঁস হয়েছে।
রাজস্থানে ২০১৫ থেকে ২৩ পর্যন্ত ১৪বার পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রশ্নফাঁস হয়েছে। গুজরাটেও ১৪ বার পিএসসির পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস হয়েছে।
আর কত উদাহরণ দেব। পরীক্ষায় ডিগ্রি পাওয়া তো এখন 'ফেলো কড়ি মাখো তেল' পর্যায়ে চলে গেছে। চাকরির পরীক্ষাও তাই। বিষয়টি সবাই জানেন। কিন্তু যখন সংবাদমাধ্যমে এনিয়ে হইচই হয়, ভিডিও সামনে আসে, তখন গেল গেল রব তোলেন। অনেকদিনই তো সব রসাতলে গেছে। আমরা তো ছাত্রাবস্থায় দেখেছি, ছাত্রনেতারা কীভাবে প্রথম শ্রেণি পেতেন, তারপর কী অনায়াসে সরকারি স্কুল-কলেজে শিক্ষক, অধ্যাপকের চাকরি পেতেন। তখনো টাকা দিয়ে চাকরি পাওয়ার অভিযোগ উঠত। এখন আরো নগ্ন ও বেপরোয়াভাবে সেই কাজ করা হয়।
ফলে সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। শিক্ষায় দুর্নীতির ট্র্যাডিশন। আগে বলা হত, 'চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পড় ধরা'। এখন তো দেখি ধরা পড়লেও অসুবিধে নেই। একটু হইচই হবে, কিছুদিন তদন্তকারীরা সক্রিয় থাকে। কয়েকজন জেলে যান। তারপর? সব ধামাচাপা পড়ে যায়। আবার প্রশ্নফাঁস হয়, আবার শিক্ষায়, চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতিতে দুর্নীতি হয়। হয়েই যাবে।