প্রসঙ্গ : পাঠকের রুচি ও অগ্রাধিকার
করোনাকালের বইমেলার ‘বেস্টসেলার’ দিয়ে কি পাঠকের সার্বিক রুচি এবং বই কেনায় পরিবর্তনের ধারা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়? তরুণ পাঠক এখন কী বেশি পড়ছেন? কেন পড়ছেন? এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন বিভিন্ন পেশার মানুষ৷
ইংরেজিতে দক্ষতা এখন অনেক জরুরি
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এএফপি’র সাংবাদিক স্যাম জাহানের মতে, ‘‘বিগত এক দশকের আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় তরুণদের কাছে শিল্প-সাহিত্য চর্চার চেয়ে ইংরেজি শেখাটা এখন বেশি লাভজনক বিনিয়োগ৷ বিপুল সংখ্যক মানুষ, বিশেষ করে তরুণ সমাজের একটা বড় অংশ উন্নত জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে এখন দেশত্যাগে আগ্রহী৷ বিদেশে স্থায়ী হওয়ার জন্য ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হওয়া জরুরি, তাই সেদিকেই তাদের মনোযোগ বেশি৷’’
অনিশ্চয়তার মধ্যে সাহিত্য-চর্চা সম্ভব না
ইকমার্স নির্বাহী সামিউর রহমান বলেন, ‘‘তরুণদের বই পড়ায় আগ্রহ কমছে, আমি তা মনে করি না৷ গত কয়েক বছরে তরুণদের মধ্যে আত্মোন্নয়ন এবং ইংরেজি শেখার চাহিদা কয়েকগুণ বেড়েছে৷ অনেক দেশের তুলনায় আমাদের ইংরেজি শিক্ষার মান অত্যন্ত দুর্বল৷ আমাদের তরুণদের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত৷ সুতরাং এই অবস্থায় সাহিত্য-চর্চা শুধু নাটক-সিনেমাতে সম্ভব, বাস্তবে নয়৷’’
বিষয়টি দ্বান্দ্বিক এবং অশনিসংকেত
লেখক ও আলোকচিত্রী শাহরিয়ার খান শিহাব বলেন, তরুণ সমাজ যে-কোনো বই পড়ছে বিষয়টি আনন্দের৷ তবে বইমেলায় কেন সৃষ্টিশীল রচনা সর্বোচ্চ বিক্রির আসনে নেই, সেখানে কেন একটি ভাষা শিক্ষার বই, এটি একটি দ্বন্দ্বপূর্ণ আলাপ৷ অন্তরালের কারণ হিসেবে বলা যায়, এখনকার লেখকদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে লেখনীর মান যেমন তলানিতে যাচ্ছে, তেমনি পাঠ্যপুস্তকের বাইরের মৌলিক বইয়ের প্রতিও তরুণদের অনীহা বাড়ছে, এটা আশঙ্কাজনক৷
সৃষ্টিশীল বই পড়ার সুযোগ কম
ঢাকা ডেন্টাল কলেজের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী মাশুক শাহরিয়ার বলেন, ‘‘আমার আশেপাশের সবাই এখন পড়াশোনা, চাকরি এবং ক্যারিয়ার নিয়ে উদ্বিগ্ন৷ তীব্র প্রতিযোগিতার এই যুগে পাঠ্যপুস্তক পড়ার পর যেটুকু সময় হাতে থাকে, তা আমরা অনলাইনে দেই৷ আমি নিজেই আগের মতো গল্প বা উপন্যাসের বইয়ের প্রতি সেভাবে আগ্রহ অনুভব করি না৷ বিগত কয়েক বছরের দিকে তাকালে দেখা যায়, এখন মানুষ বই কিনছে মনের খোরাক মেটাতে নয়, প্রয়োজনের তাগিদে৷’’
বই পড়া বাদেও এখন অপশন অনেক
ব্যাংক কর্মরত ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘‘আমাদের সময়ে আমরা তিন গোয়েন্দা, কমিকস এসব বই পড়তাম, কারণ, আমাদের অপশন ছিল না৷ এখন ছেলেমেয়েদের ঘরে বসে সময় কাটানোর মাধ্যমের অভাব নেই৷ সৃষ্টিশীল বই-বিমুখতার পিছনে অভিভাবকরাও দায়ী, তারা সন্তানদের পাঠ্যপুস্তকের বাইরের বই পড়তে দিতে আগ্রহী না৷ যেহেতু এখন সব ক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতা বেশি, ইংরেজিতে দক্ষতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, সুতরাং এ ধরনের বইয়ের প্রতি ঝোঁকটা স্বাভাবিক৷’’
মৌলিক চাহিদা সবার আগে
চাকরিপ্রত্যাশী স্থপতি এনায়েত হোসেন বলেন, ‘‘একজন মানুষ শিল্প-সাহিত্যের দিকে তখনই মনোনিবেশ করবে যখন তার মৌলিক চাহিদা পূরণ হবে,পেটভরা থাকবে৷ তরুণ সমাজ এখন হতাশায় ভুগছে, বিভিন্ন দিকে তারা ব্যর্থ৷ এ থেকে পরিত্রাণ পেতে তারা অনুপ্রেরণামূলক বই অথবা ইংরেজির মতো আন্তর্জাতিক ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহী হচ্ছে৷ তরুণদের বেকারত্ব, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে এইসব সাহিত্য চর্চা এখন বিলাসিতারই নামান্তর বলে আমি মনে করি৷’’
মানুষ বই কিনছে নিতান্তই প্রয়োজনে
প্রতীক প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধার নূর ই প্রতীক বলেন, ‘‘মানুষ এখন নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া বই কেনে না৷ বিষয়গুলো মানুষের আর্থিক সচ্ছলতার সাথে কিছুটা জড়িত৷ তবে ইংরেজি ভাষা বা অনুপ্রেরণামূলক বই বেস্ট সেলার হচ্ছে মানে যে অন্যান্য বই বিক্রি একদম কম হয়, বিষয়টা তা-ও না৷ মানুষ বই পড়ছে, তবে সেসব বই বিক্রির তথ্য অতটা আলোকপাত হয় না৷ কে জানে, পরের বছরে হয়ত কোনো সৃষ্টিশীল বই সর্বোচ্চ বিক্রির জায়গা দখল করতেও পারে৷’’
সংখ্যা সবকিছু যাচাইয়ের মাপকাঠি নয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক বলেন, ‘‘দেখা যায় একটি ‘গম্ভীর’ বইয়ের তুলনায় একটি সাধারণ বই অনেক বেশি বিক্রি হচ্ছে৷ সব বইয়ের পাঠক যে সবাই না, এটাও বুঝতে হবে৷ যা প্রয়োজনে কেনা হয়, সেটা দিয়ে পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গি মাপা কঠিন৷ তরুণরা বই পড়ছে এবং কিনছে৷ গতবছর প্রায় ৮২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়, যার অধিকাংশ ক্রেতা এই তরুণেরা৷ যুগ ডিজিটাল হচ্ছে, কিন্তু বই পড়া থেমে নেই৷’’
তরুণ প্রজন্ম এখন বাস্তববাদী এবং সচেতন
একটি আন্তর্জাতিক এনজিওর পরামর্শক মোস্তফা ফেরদৌস ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘‘আমার আশেপাশের তরুণরা এখন চাকরি, ব্যবসা, সর্বোপরি ভবিষ্যৎ নিয়ে সচেতন৷ মহামারির কারণে সবাই চাচ্ছে ঘরে বসেই নিজেদের দক্ষতাকে শাণিত করতে৷ তবে আমি দেখেছি যারা প্রকৃত পাঠক, তারা বই কিনছেই৷ কিন্তু বই পড়ার আগ্রহ একদম কম দেখতে পাচ্ছি অপেক্ষাকৃত নতুন প্রজন্মের মাঝে, যারা ডিজিটাল দুনিয়ায় নিজেদের হারিয়েই ফেলছে বলা চলে৷’’