অভিজিৎ হত্যাকাণ্ড
২ মার্চ ২০১৫
রাজীবকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই হত্যা করা হয়েছে ড. অভিজিৎকে৷ রাজীবকেও হত্যার আগে সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোতে হুমকি দেয়া হয়েছিল৷ আবার ড. অভিজিৎকেও হত্যার আগে একই কায়দায় হুমকি দেয়া হয়৷ এই হুমকিদাতাদের অন্যতম শাফিউর রহমান ফারাবী নামের একজন উগ্রবাদী ব্লগার৷ ফারাবীকে সোমবার রাজধানী ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে ব়্যাব৷
ড. অভিজিতের সম্ভাব্য খুনি হিসেবে যাদের ধরা হচ্ছে, তাদের সকলকেই এর আগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল৷ তবে বর্তমানে তারা সবাই জামিনে রয়েছে৷ ২০১৩ সালের ১২ই আগস্ট বরগুনা থেকে ৩০ সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছিল আনসার উল্লাহ বাংলা টিম-এর প্রধান মুফতি জসিম উদ্দিন রাহমানীকে৷ এরপর তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২৫শে আগস্ট রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে আরো ন'জনকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ এক বছরের বেশি সময় এরা কারাগারে ছিল৷
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (গোয়েন্দা) মনিরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, গত বছরের একেবারে শেষের দিকে আনসার উল্লাহ বাংলা টিম-এর সাতজন ভয়ংকর জঙ্গি জামিনে মুক্তি পায়৷ তারা হলো – রেজওয়ান শরীফ, আলী আজাদ, নাইমুল হাসান নাইম, সাইফুল, আমিনুল, জাহিদুল ইসলাম জাহিদ ও জুন্নুন সিকদার৷ অথচ এদের গ্রেপ্তারের সময় জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অনেক তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল৷ এরাই ড. অভিজিতের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারে বলে জানা গেছে৷ তাই আবারো এদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি৷
সোমবার ব়্যাব-এর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে শাফিউর রহমান ফারাবী৷ এই ফারাবীকে আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডের পর গ্রেপ্তার করেছিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ৷ উচ্চ আদালত থেকে ফারাবী জামিন পেয়েছিল, কারণ রাজীব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ফারাবীকে সম্পৃক্ত করেনি গোয়েন্দা পুলিশ৷ তবে অভিজিত্ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ফারাবীর সম্পৃক্ততা ইতিমধ্যেই নিশ্চিত করেছে গোয়েন্দা পুলিশ৷
গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ফেসবুক থেকে আমরা ফারাবীর কিছু হুমকি ও অভিজিতের সঙ্গে কথোপোকথন বের করেছি৷ সেখানে ফারাবী স্পষ্ট লিখেছে, অভিজিত্ যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করায় তাকে হত্যা করা যাচ্ছে না৷ যখন সে দেশে আসবে তখন তাকে হত্যা করা হবে৷''
কৃষ্ণপদ রায় বলেন, ‘‘যদি ধরেও নিই যে, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি ফারাবীর কোনো সম্পর্ক নেই, তারপরও হত্যার হুমকি ও বিভিন্ন সময় ফেসবুকে ড. অভিজিৎকে হত্যা করতে ফারাবীর ফতোয়াগুলোর কারণেই সে এই মামলার একজন গুরুত্বপূর্ণ আসামী৷''
ড. অভিজিত্ হত্যাকাণ্ডের পর সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক অনলাইন নিউজপেপার বিডিনিউজকে বলেন, ‘‘লেখক অভিজিত্ রায়ের রক্তের দাগ বিচার বিভাগের হাতেও রয়েছে৷'' এই ধরনের ঘটনায় আদালত থেকে সন্দেহভাজন অপরাধী ব্লগার শাফিউর রহমান ফারাবীর জামিন আদেশের দিকে ইঙ্গিত করে বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, ‘‘অভিজিতের ব্যাপারে আমার কথা হচ্ছে, আমাদের সকলকে রুখে দাঁড়াতে হবে৷ যারা এমন ঘটনার ‘সাসপেক্টেড' খুনিকে চটজলদি জামিন দিয়েছে, তাদের হাতেও অভিজিতের রক্তের দাগ লেগে আছে৷ এ ঘটনায় প্রমাণিত হয়, আমাদের পুলিশ ‘ইনইফিশিয়েন্ট'৷ সাসপেক্টেড খুনি কারাগারে ছিল, কিন্তু ‘বেইল' নিয়ে বের হয়ে গেল৷ তাই বলা যায়, বিচার বিভাগের হাতেও রক্তের দাগ লেগে আছে৷''
এই শাফিউর রহমান ফারাবীকেই সোমবার সকালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে ব়্যাব৷ ফারাবীকেই ড. অভিজিতের সন্দেহভাজন খুনি হিসেবে দেখা হচ্ছে৷ ব়্যাব-এর অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ফারাবী এর আগে ব্লগার রাজীব হত্যাকাণ্ডের পর ফেসবুকে উসকানিমূলক ‘স্ট্যাটাস' দিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিল৷ উগ্রবাদীদের পক্ষে বিভিন্ন সময় কার্যক্রম পরিচালনাকারী ফারাবী বাংলা বই বিক্রির ওয়েবসাইট ‘রকমারি ডটকম' থেকে অভিজিত্ রায়ের বই সরাতেও হুমকি দিয়েছিল৷
কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, ‘‘বিভিন্ন সময়ে ফারাবী ফেসবুকে অভিজিতের পরিবারের সদস্যদের ছবি ও ‘স্ট্যাটাস' দিয়েছে, যাতে দেশে এলে অভিজিতকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে৷'' তাছাড়া ফেসবুকে ‘ফারাবী ব্লগ' নামের একটি পৃষ্ঠায় সে ধর্মীয় উসকানিমূলক স্ট্যাটাসও দিত বলেও জানান তিনি৷ ২০১৩ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি ব্লগার আহমেদ রাজীব হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর জানাজা পড়ানোয় ইমামকে হত্যার হুমকি দিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছেলে ফারাবী৷ এরপর ঐ বছরের ২৪শে ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ কিন্তু ২০১৩ সালের ২১শে আগস্ট জামিনের পর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে যায় ফারাবী৷
প্রসঙ্গত, গত ২৬শে ফেব্রুয়ারি রাতে স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে সঙ্গে নিয়ে বইমেলা থেকে ফেরার পথে বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলন চত্বরের উল্টো পাশে সোহরাওয়ার্দি উদ্যান সংলগ্ন ফুটপাতে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ড. অভিজিৎকে৷
জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে দোষীদের আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানায়৷ যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে সহায়তার আগ্রহ দেখালে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাতে সম্মতি দেয়া হয়েছে বলে রবিবার সাংবাদিকদের জানান স্বয়ং পররাষ্ট্রমন্ত্রী৷