একটু আগে টাইব্রেকারে স্পেনকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছে মরক্কো৷ তাই হর্ন বাজিয়ে আনন্দ প্রকাশ করছে মরোক্কানরা৷ রাস্তায় গাড়ির হর্নও ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে৷ গাড়ির ভিতর থেকে পতাকা উঁচিয়ে অনেক চিৎকার করে জানান দেয় মরক্কো জিতেছে৷
কিছুদূর এগোতেই দেখা গেল কয়েকশ' মরোক্কান রাস্তায় জড়ো হয়েছে৷ অনেকের হাতে পতাকা৷ নেচে-গেয়ে উদযাপন করছে তারা৷ ট্রাফিক নিয়মের বালাই না করে রাস্তা দখল করে তারা উৎসবে মেতে ওঠে৷ অল্প সময়ের মাঝে মনে হলো আফ্রিকান দেশটি থেকে আসা সকল নারী-পুরুষ রাস্তায় নেমে এসেছে৷ হাড় কাঁপানো শীতে মাঝরাত পর্যন্ত ঐতিহাসিক জয় উদযাপন করে তারা৷
ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর হচ্ছে তা এর আগে এই শহরে টেরই পাওয়া যায়নি৷ বিশ্বকাপে ইউরোপ মহাদেশ থেকে বেশি দেশ খেলে৷ জার্মানিসহ এবার খেলেছে ১৩টি দেশ৷ ২০১০ থেকে পরপর তিনটি বিশ্বকাপ জিতেছে যথাক্রমে স্পেন, জার্মানি এবং ফ্রান্স৷ এছাড়াও রয়েছে পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, ক্রোয়েশিয়া, পোল্যান্ড, সুইজারল্যান্ডের মতো ভালো দল৷
অথচ এই শহরে যেন কেউ খেলা দেখছে না৷ দু-একটি বাদে রেস্তোরাঁ বা পাব কোথাও টেলিভিশনে খেলা নেই৷ রাস্তায় নেই বড় ডিজিটাল মনিটর৷ নেই কোনো উম্মাদনা বা মাতামাতি৷ ভেবেছিলাম জার্মানির ম্যাচের দিনে হয়ত বোঝা যাবে৷ কিন্তু না, সেসব দিনেও বন শহর ছিল নীরব৷ যদিও জার্মানি প্রথম পর্ব থেকেই বিদায় নেয়৷
এই চিত্র যে শুধু বন শহরের তা নয়, বরং ইউরোপের অন্যসব শহরের দৃশ্যপটও এরকমই৷ তাহলে কি ফুটবল-পাগল ইওরোপিয়ানরা এবার বিশ্বকাপ দেখছে না?
ফুটবল মানেই উৎসব৷ বিশ্বকাপের সময় বড় বড় শহর যেন থেমে যায়৷ সবাই ব্যস্ত থাকে টিভি অথবা বড় ডিজিটাল মনিটরে খেলা দেখতে৷ বার্লিন বা বার্সেলোনার মতো শহরে চেহারাই পাল্টে যায় বিশ্বকাপের সময়৷ ২০১৮ সালের বিশ্বকাপের সময়েও এই চিত্র দেখা যায়৷ কিন্তু এবার কোনো উৎসব হচ্ছে না৷
খেলার সময় পাব ও বারে থাকতো মানুষের ভিড়৷ বিয়ারের গ্লাস হাতে চিৎকার করে অনেকে উল্লাস করে খেলা উপভোগ করতো৷ এছাড়াও খেলা দেখার জন্য খোলা জায়গায় বসানো হতো বড় বড় ডিজিটাল স্ক্রিন৷ এবার সেই চিত্রটিও অনুপস্থিত৷
বেশ কিছু কারণে এবার খেলা নিয়ে উদাসীনতা তৈরি হয়েছে ইউরোপিয়ানদের মাঝে৷ আগের আসরগুলো গরমকালে আয়োজন করা হলেও এবারের বিশ্বকাপ হচ্ছে শীতকালে৷ শীতের মধ্যে পাব বা খোলা স্থানে খেলা দেখা কঠিন৷ তাই হয়ত অনেকে ঘরে বসে খেলা দেখতে পারেন৷
তবে খেলা না দেখা বা এবারের বিশ্বকাপ নিয়ে অনাগ্রহের পেছনে বড় দুটি কারণ৷ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে বসেছে বিশ্বকাপ ফুটবলের ২২তম আসর৷ বিশ্বকাপ শুরুর আগেই মানবাধিকার প্রশ্নে কাতারের সমালোচনা শুরু হয় ইউরোপের অনেক দেশে৷ আয়োজনের প্রস্তুতিতে কয়েক হাজার শ্রমিকের মৃত্যু, মৃত্যুর তদন্ত না হওয়া, তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপার সামনে চলে আসে৷
এরপর শুরু হয় ওয়ান লাভ আর্মব্যান্ড বিতর্ক, যার মাধ্যমে ইউরোপে সকল প্রকার জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ, বয়স, বিশ্বাস, সংস্কৃতি আর যৌনতার ক্ষেত্রে বৈষম্যের বিরোধিতা করা হয়৷ ইউরোপের সাতটি দেশ ইংল্যান্ড, ওয়েলস, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি ও ডেনমার্কের ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেনরা এবারের কাতার বিশ্বকাপে বাহুতে ওয়ান লাভ ব্যান্ড পরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন৷ কিন্তু ফিফার হুঁশিয়ারির পর ওই ব্যান্ড পড়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে দেশগুলো৷
জার্মানি-জাপান ম্যাচে খেলার শুরুর আগে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে প্রতিবাদ জানায় জার্মানির খেলোয়াড়রা৷ মাঠের বাইরে প্রাক্তন এক ড্যানিশ প্রধানমন্ত্রী, জার্মান ফেডারেল মিনিস্টার, বিবিসির স্পোর্টস প্রেজেন্টার এবং ইংল্যান্ডের সাবেক নারী খেলোয়াড় অ্যালেক্স স্কটকে রেইনবো আর্মব্যান্ড পরতে দেখা যায়৷ ড্যানিশ এক টিভি রিপোর্টার ওয়ান লাভ আর্মব্যান্ড পরেছিলেন, পরে কাতারি এক কর্মকর্তা তাকে সেটি খুলে ফেলতে বলেন৷
এসবের বিরূপ প্রভাব পড়ে ইউরোপিয়ানদের মাঝে৷ এছাড়াও খেলার দুই দিন আগে মাঠে অ্যালকোহল নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তও তিক্ত পরিস্থিতির জন্ম দেয়৷ এসবের প্রতিবাদ জানিয়ে জার্মান ফুটবলার ফিলিপ লাম কাতারে বিশ্বকাপ দেখতে যাননি৷ অধিকাংশ পাব ও বার জানিয়ে দেয় এবার তারা খেলা দেখার আয়োজন করছে না৷
তরুণদের মধ্যেও এবারের বিশ্বকাপ নিয়ে আগ্রহ অনেক কম৷ তারাও হয়ত নীরবে প্রতিবাদ জানাতে চেয়েছে৷ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও ছাত্রদের আলোচনাতেও চলে আসে কাতারের বিষয়গুলো৷ ফলে অনেকে খেলা দেখার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে৷ সব মিলিয়ে এবারের বিশ্বকাপ ফুটবল আসর শেষ হচ্ছে, কিন্তু তার আঁচ ইউরোপে পাওয়া গেল না৷
তবে মরক্কো কোয়ার্টার ফাইনালে জিতে সেমি ফাইনালে উঠলে বন শহরের বাসিন্দারা আরেকটি উদযাপন দেখে৷ শুধু বন নয়, ইউরোপের অনেক শহরেই তারা রাস্তায় বেরিয়ে জয়ের আনন্দে উৎসব করেছে৷