ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণের দাবি
২৪ অক্টোবর ২০১১ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন৷ পঞ্চদশ শতকে ফ্রাঙ্কফুর্টের অদূরে মাইন্সে ছাপাখানা আবিষ্কার করেন ইয়োহানেস গুটেনব্যার্গ৷ তখন থেকেই তিনি তাঁর আবিষ্কৃত ছাপাখানার উপকরণ এবং ছাপানো বই-পুস্তক বিক্রির জন্য ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে যেতেন৷ সেই থেকে ধীরে ধীরে জার্মানি ও ইউরোপের নানা প্রান্ত থেকে বই ও ছাপাখানার সাথে জড়িত মানুষ ফ্রাঙ্কফুর্টমুখী হতে শুরু করেন৷ এরপর ঐতিহাসিক পট পরিবর্তনের কারণে সেখানে বইপ্রেমীদের সমাগম বিভিন্ন সময় বাধাগ্রস্ত হলেও শেষ পর্যন্ত ১৯৪৯ সালে এটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয় জার্মান প্রকাশক সমিতি৷ তবে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা আন্তর্জাতিক চেহারা পায় ১৯৬৪ সাল থেকে৷
কালক্রমে এই বইমেলায় যোগ হচ্ছে আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক নানা সুযোগ-সুবিধা ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামো৷ বইমেলা শুনলেই অধিকাংশ মানুষ ভেবে থাকেন বই প্রদর্শনীর পাশাপাশি কেনা-বেচার সুযোগ নিশ্চয় সেখানে থাকবে৷ কিন্তু ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা এখন আর সেই পর্যায়ে নেই৷ এই মেলা পরিণত হয়েছে বইয়ের জগৎ নিয়ন্ত্রণকারী প্রকাশক ও লেখকদের মালিকানাধীন উপকরণসমূহ বাজারজাতকরণের স্থানে৷ বিশেষ করে কোন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান যদি কোন বই প্রকাশ কিংবা অনুবাদ করতে চায়, তাহলে সেই অধিকার তাকে কিনতে হবে স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান বা এজেন্টের কাছ থেকে৷ আর সেই অধিকার কেনা-বেচার জায়গা হলো এই বইমেলা৷ ফলে এটিকে অনেকে স্টক এক্সচেঞ্জের সাথে তুলনা করেন৷ কারণ এই স্বত্বাধিকার কেনা-বেচায় প্রতিদিন এই মেলা প্রাঙ্গণে কোটি কোটি ইউরোর চুক্তি হয়ে থাকে৷
অবশ্য, কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ভিত্তিক আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে ছাপানো বইয়ের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে ই-বুকের ধারা৷ ফলে ছাপানো বইকে এখন পাল্লা দিতে হচ্ছে ডিজিটাল প্রকাশনার সাথে৷ তাই বইয়ের প্রকাশনার মান এতোটা উন্নত করতে হচ্ছে প্রকাশকদের যাতে পাঠক এখনও ছাপানো বইয়ের দিকে ঝোঁকেন৷ সে কারণেই হয়তো ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলায় বিশেষভাবে চোখে পড়ে ছাপানো বইগুলোকে নানা ঢঙে উপস্থাপনার প্রচেষ্টা৷ এছাড়া শিশুদের বইগুলোতে নানা আকার-আকৃতি ও চমকের সমাহার৷ তবে এবারের বইমেলায় ই-বুকের ব্যাপকতার ফলে স্বত্বাধিকার আইন লঙ্ঘনের হার বৃদ্ধির বিষয়টি ছিল প্রায় সব আলোচনার আসরে৷ কারণ ইন্টারনেটের মাধ্যমে অনেকে অবৈধভাবে বই প্রকাশ ও বিনামূল্যে বই ডাউনলোড করে পড়ার সুযোগ নিয়ে থাকে৷ তাই সারাবিশ্বে ই-বুকের জগতে স্বত্বাধিকার আইনের যথাযথ প্রয়োগের পন্থা ও কৌশল নিয়ে বেশ বিতর্ক শোনা গেছে৷
এছাড়া বইয়ের পাশাপাশি সময়ের বিবর্তনে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় জায়গা করে নিয়েছে চলচ্চিত্র ও কম্পিউটার প্রতিষ্ঠানগুলোও৷ এসব প্রতিষ্ঠানের স্টলগুলোর দিকে দর্শকদের আগ্রহের মাত্রা বেশি ছিল বলে জানিয়েছেন ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার পরিচালক ইউর্গেন বোস৷ বিশেষ করে তরুণ এবং প্রবীণদেরকেও বেশি করে দেখা গেছে জার্মান বেশ কিছু টেলিভিশন চ্যানেলের বই ও প্রকাশনা জগত নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানগুলোতে৷ প্রায় প্রতিটি হলেই বিশিষ্ট লেখক, সাহিত্যিকদের নিয়ে এসব আলোচনা পর্বের লাইভ সম্প্রচারের আসরে দেখা গেছে দর্শকদের ভিড়৷
এবারের বইমেলায় বিশ্বের ১০৬টি দেশ থেকে সাত হাজার ৩৮৪ টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে৷ পাঁচ দিনব্যাপী এই আন্তর্জাতিক বইমেলায় দর্শক ছিল দুই লাখ ৮৩ হাজার৷ আয়োজকদের মতে, ২০১০ সালের বইমেলার চেয়ে এবার দর্শক বেড়েছে এক শতাংশ৷ যাহোক, সারাবিশ্বের এতো প্রতিষ্ঠানের সমাগম হলেও বাংলাদেশের কোন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ছিল না এবারের বইমেলায়৷ তাই বাংলাদেশের দর্শকদের মাঝে দেখা গেছে হতাশা ও আক্ষেপ৷ বইমেলায় উপস্থিত জার্মানির ডর্টমুন্ড ও স্টুটগার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রীরা জানালেন তাদের মনোবেদনার কথা৷ তাঁরা সরকার ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আগামীতে এই মেলায় অংশগ্রহণে উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানান৷ অবশ্য কলকাতার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর স্টলে বাংলা ভাষার বইয়ের সমারোহ দেখতে পেয়ে কিছুটা সান্ত্বনা খুঁজে পান মেলায় আসা বাংলা ভাষাভাষী মানুষ৷
বাংলাদেশের অঙ্কুর প্রকাশনীর পরিচালক মেসবাহুদ্দীন আহমেদ অবশ্য বলছেন, বাংলাদেশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা না পাওয়ার কারণেই এই বইমেলায় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে অংশগ্রহণ সম্ভব হয় না৷ এই বইমেলায় যেহেতু বই কেনা-বেচা হয় না, তাই সরকারের আর্থিক সহযোগিতা ছাড়া এখানে অংশগ্রহণ বাংলাদেশের যে কোন প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই কষ্টসাধ্য৷ তবে আগামীতে বিশ্বের বৃহত্তম এই বইয়ের আসরে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হলে সরকার এবং প্রকাশক সমিতি উভয় পক্ষকেই যৌথভাবে উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন তিনি৷
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক