ফ্রান্সের পরমাণু পরীক্ষার শিকার মানুষরা আজও ক্ষতিপূরণ পান নি
৪ আগস্ট ২০১১ফ্রান্সের পরমাণু কর্মসূচি
১৯৬০ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে ফ্রান্স মোট ২১০টি পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে৷ এই তালিকায় একমাত্র সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ৭১৮ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১,০৩৯টি এমন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফ্রান্সের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে৷ প্রথমদিকে ফ্রান্স তার প্রাক্তন উপনিবেশ আলজেরিয়াকে পারমাণবিক পরীক্ষার জন্য বেছে নিয়েছিল৷ তারপর সেদেশ প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণে পলিনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জে নিজস্ব ভূখণ্ডে পরীক্ষা চালাতে থাকে৷ গোটা কর্মযজ্ঞে সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তি মিলিয়ে প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ অংশ নিয়েছিলেন৷ প্রায় ৫,০০০ মানুষ আজও জীবিত৷ তাদের মধ্যে প্রায় ৩৫ শতাংশ ক্যান্সার রোগে ভুগছেন৷ তাদের করুণ অবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে দুটি সংগঠনের আপ্রাণ চেষ্টা চালানোর পর ২০১০ সালের জুন মাসে তাদের ক্ষতিপূরণের জন্য ফ্রান্সে একটি আইন কার্যকর হয়েছে৷ তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যার্ভে মোব়্যাঁ বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তির উদ্দেশ্যে বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন৷ কিন্তু সেই অর্থ আজও সব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে পৌঁছয় নি৷
ক্ষতিপূরণ আইন নিয়ে জটিলতা
ক্ষতিপূরণ আইন কার্যকর হবার ঠিক এক বছর পর, অর্থাৎ গত জুন মাসে প্রথম ব্যক্তি ক্ষতিপূরণের খবর পেলেন৷ ফরাসি সেনাবাহিনীর এই প্রাক্তন সদস্য নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক৷ বহুদিন ধরে তিনি মারাত্মক ত্বকের ক্যান্সারে ভুগছেন৷ এই ঘটনার এক প্রতীকী তাৎপর্যও রয়েছে৷ ১৯৬০ সালের শুরুতে সাহারা মরুভূমিতে ফ্রান্স যখন প্রথম পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায়, তখন তরুণ সৈন্য হিসেবে এই ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত ছিলেন৷ বিস্ফোরণের কেন্দ্রস্থলের খুবই কাছে পর্যবেক্ষক হিসেবে তাকে দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছিল৷ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘সেসময়ে আমরা সুরক্ষার জন্য এক ধরণের সাদা পোশাক পরতাম৷ সঙ্গে থাকতো দস্তানা ও গ্যাস মুখোশ৷ তবে সেই সব সরঞ্জাম ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের৷''
ফরাসি কর্তৃপক্ষ আরও ১১ জনের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করেছে৷ কিন্তু এই লক্ষ্যে গঠিত কমিশন সবার ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের দাবি মানতে প্রস্তুত নয়৷ ৫০০রও বেশি ব্যক্তি আশঙ্কা করছেন, যে তাদের আবেদন নাকচ হয়ে যাবে৷ ফ্রান্সের সমাজতন্ত্রী দলের সাংসদ জঁ পাত্রিক গিল এই আইনের প্রয়োগ সম্পর্কে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ৷ এক সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে তিনি বলেন, ‘‘এই আইন আসলে অনেকটাই আপনাদের জন্য তৈরি করা হয়েছে৷ আপনারা, মানে সংবাদ মাধ্যমের জন্য৷ এই আইনের খসড়া তৈরি করেছিলেন যে প্রতিরক্ষামন্ত্রী, তিনি আসলে আপনাদের বুক ফুলিয়ে বলতে চেয়েছিলেন, ‘দেখুন আমি সাহস করে এমন এক স্পর্শকাতর বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছি৷' কিন্তু তিনি যাই বলুন না কেন, শুরু থেকেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, যে বাস্তবে এই আইনের প্রয়োগ কীভাবে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে৷ এই আইনের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণের দাবি সমাজের স্বীকৃতি পেয়েছে বটে, কিন্তু গোটা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কাঠামো একেবারেই অকেজো৷''
আরও স্বীকৃতির প্রচেষ্টা
দীর্ঘদিন ধরে পরমাণু বিস্ফোরণের কুপ্রভাব শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন যেসব মানুষ, তাদের আইনজীবী জঁ পোল তেসোনিয়ে একেবারেই হাল ছাড়তে প্রস্তুত নন৷ কর্তৃপক্ষ কারো আবেদন নাকচ করলেই তিনি আদালতে গিয়ে মামলা ঠুকে দিচ্ছেন৷ আইনের কাঠামোর মধ্যেও অবশ্য ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত মতবিরোধের নিষ্পত্তির ব্যবস্থা রয়েছে৷ এর আওতায় দ্বিতীয় এক কমিশনের কাজ হলো নতুন করে এই সব আবেদন খতিয়ে দেখা৷ কিন্তু সেই কমিশন এক বছরেও গঠন করা সম্ভব হয় নি৷ ফলে সরকারের সদিচ্ছার উপর ভরসা না করে ‘আভেন' নামের এক সংগঠন বিষয়টি নিজেদের হাতে তুলে নেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে৷ সংগঠনের সভাপতি জঁ লুক সঁস বললেন, ‘‘আমরা পারমাণবিক পরীক্ষার পরিণাম খতিয়ে দেখতে নিজেরাই পর্যবেক্ষকদের এক গোষ্ঠী তৈরি করছি৷ পারমাণবিক পরীক্ষার সময় যারা আশেপাশে থাকেন, তাদের স্বাস্থ্যের উপর কী প্রভাব পড়ে, সামাজিক স্তরে তাদের কোন ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, সেবিষয়ে আমরা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি৷ যারা সরাসরি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে এবং যারা আলজেরিয়া ও পলিনেশিয়ায় পরীক্ষার কেন্দ্রস্থলের কাছাকাছি বসবাস করেন, তাদের স্বাস্থ্যও পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে৷''
বাড়তি সচেতনতা
বিষয়টি সম্পর্কে সচেতনতা আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে৷ প্রায় সব রাজনৈতিক দলের মধ্যেই এই আইনের সংস্কারের দাবি উঠছে৷ পলিনেশিয়ার রাজনীতিক রিশার তুহেইআভা সেইসঙ্গে নতুন এক আইন প্রণয়নের জন্য চাপ দিচ্ছেন, যার আওতায় পরমাণু পরীক্ষার ফলে গোটা অঞ্চলে যে পরিবেশ দূষণ ঘটেছে, তারও দায় বহন করবে ফ্রান্স৷ ফ্রান্সের কিছু রাজনীতিকও তাঁকে এই প্রশ্নে সমর্থন করছেন৷ বহুকাল ধরেই পলিনেশিয়ায় পরমাণু পরীক্ষার পরিণামের খুঁটিনাটি বিষয়গুলি ফ্রান্স প্রকাশ্যে জানায় নি৷ সম্প্রতি সেদেশের এক উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, এই পরীক্ষার ফলে গোটা অঞ্চলে মারাত্মক সুনামিও ঘটতে পারতো৷ বলাই বাহুল্য, এই স্বীকারোক্তির ফলে ফ্রান্স ও তৎকালীন পলিনেশিয়ার স্থানীয় সরকারের বিরুদ্ধে তুমুল সমালোচনার ঝড় উঠেছে৷ কোনো না কোনো সময়ে ফ্রান্সকে যে ক্ষতিপূরণ সহ গোটা বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করতে হবে, এবিষয়ে প্রায় সব মহলই একমত৷
প্রতিবেদন: সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা: হোসাইন আব্দুল হাই