বস নারী হলেও তাকে পুরুষ মনে হয়
২৫ জুন ২০২১বর্ধমানের এক ঘটনা মনে পড়ে গেল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন সবেমাত্র সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, জেলায় জেলায় ঘুরে প্রশাসনিক বৈঠক করবেন। সেই বৈঠক লাইভ টেলিকাস্টও করা হবে। যাতে প্রশাসন নিয়ে মানুষের মনে কোনো অস্বচ্ছতা না থাকে। পশ্চিমবঙ্গের একটি বহুলপ্রচারিত সংবাদপত্রে কাজ করি তখন। অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হলো, মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক বৈঠক কভার করতে হবে।
একদিকে সার বেঁধে বসে আছেন আইএএস, আইপিএস অফিসাররা। তার পাশে ডিএম, এসপি, এসডিও, বিডিও। অন্যদিকে, জেলার বিধায়ক, সাংসদ, পঞ্চায়েত সদস্যরা। প্রশাসনিক বৈঠক চমকপ্রদ হওয়ার কথা নয়। বেশ বোরিং। গ্রীষ্মের দুপুরে এসির হাওয়ায় খানিক ঝিমিয়েই পড়েছিলাম। আচমকা, বাক্যটি শুনে ঝিম কাটল। সদ্য ভিন রাজ্য থেকে আসা আইপিএস অফিসার মুখ্যমন্ত্রীকে সম্বোধন করছেন 'ম্যাডাম স্যার' বলে। বৈঠক শেষে রাজ্যের এক শীর্ষ পুলিশ অফিসারকে ফোন করে ছিলেন সাংবাদিক। প্রশ্ন শুনে তিনি হাসতে হাসতে প্রায় চেয়ার থেকে উল্টে পড়ার অবস্থা। 'উত্তর ভারতে কিছুদিন কাজ করে এসো, বুঝলে হে তরুণ সাংবাদিক! একজন নারী যে হায়ারার্কিতে উপরে হতে পারেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মানসিক ভাবে তা মেনে নিতে পারে না। ফলে নারী বসকে ম্যাডাম স্যার, এমনকী, শুধু স্যার বলারও প্রবণতা আছে।' পশ্চিমবঙ্গে সব আইপিএস এবং আইএএস অফিসার অবশ্য এ ভাষায় কথা বলেন না। নারীকে শুধুমাত্র ম্যাডাম বলার চলই বেশি। তবে আদালতের বিষয়টি আলাদা। তবে তিনি একা নন, রাজ্যে শীর্ষপদে থাকা এক আইএএস অফিসার মুখ্যমন্ত্রীকে স্যার বলেই ডাকতেন।
অরিন্দম দাস দীর্ঘদিন ধরে কলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে প্র্যাকটিস করছেন। সুপ্রিম কোর্টেও নিয়মিত যাতায়াত আছে। সম্প্রতি এলাহাবাদ হাইকোর্ট এবং মাদ্রাজ হাইকোর্টেও মামলা লড়ে এসেছেন। সাংবাদিকের সঙ্গে আড্ডায় তিনি বলছিলেন, হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে মামলা লড়ার সময় ইওর অনার, লর্ডশিপ বলার রীতি আছে। নারী বিচারপতি থাকলেও তাকে লেডিশিপ বলা হয় না। লর্ডশিপই বলা হয়। দুই একবার এই রীতি ভেঙে তিনি লেডিশিপ বলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ধোপে টেকেনি। অরিন্দমের রসিক মন্তব্য, ''গুরু, প্রথা ভেঙে কিছু করতে গিয়ে বিচারপতিকে চটিয়ে দিয়ে তো লাভ নেই। ক্লায়েন্ট একটাই বিষয় দেখবে, কেস জিততে পারলাম, না পারলাম না। হেরে গেলে কি তুমি আমার কথা খবরের কাগজে লিখবে?''
ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। অরিন্দমের মতো আরো অনেক আইনজীবীরই বক্তব্য, আদালতে রীতি ভাঙা কোনো কিছু করে স্টেডিয়ামের জন্য খেলে লাভ নেই। নিয়ম মেনে মামলা জেতাই জরুরি। অকারণ বিচারক বা বিচারপতির বিরাগভাজন হয়ে লাভ কী? সুপ্রিম কোর্টে অবশ্য এক বহু সিনিয়র আইনজীবীকে দিনের পর দিন নারী বিচারপতিকে লেডিশিপ বলতে শুনেছি। অরিন্দমের সহাস্য মন্তব্য, ''সুপ্রিম কোর্টে তাও চলে। লোয়ার কোর্টে এ সব বিপ্লব করার মানে হয় না।'' জেলা আদালতে দেখেছি, আইনজীবীরা নির্দ্বিধায় নারী বিচারককে স্যার বলেন। 'ম্যাডাম স্যার'ও নয়।
বছরখানেক আগে একটি আর্টিকাল ফিফটিন নামের একটি সিনেমা তৈরি হয়েছিল। উত্তর ভারতের পটভূমিকায় তৈরি ওই ছবিতে নারী অফিসারকে স্যার বলার প্রসঙ্গটিও ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতে বাস্তবে কোনো পরিবর্তন হয়নি। পুরুষতান্ত্রিক ভারতীয় সমাজে নারীরা স্যার হয়েই থেকে গেছেন।
সাবেক কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মকর্তা সুমিত দত্ত মজুমদারের অভিজ্ঞতা অবশ্য অন্যরকম। সুমিত সেন্ট্রাল বোর্ড অফ কাস্টমস অ্যান্ড এক্সসাইজের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, দিল্লিতে কাজ করতে গিয়ে এই সমস্যা বিশেষ দেখেননি তিনি। তার নিজের নারী বস ছিলেন। তাকে বরাবরই ম্যাডাম বলে সম্বোধন করেছেন। স্যার বলতে হয়নি। বস্তুত, কেন্দ্রীয় মন্ত্রণালয়গুলিতেও নারী অফিসারদের ম্যাডাম বলে ডাকারই রীতি চালু আছে। সুষমা স্বরাজ যখন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন, অফিসাররা তাঁকে ম্যাডাম বলেই ডাকতেন। ইউপিএ আমলে লোকসভার স্পিকার ছিলেন মীরা কুমার। অধিকাংশ সাংসদই তাকে ম্যাডাম স্পিকার বলে সম্বোধন করতেন। তবে কেউ কেউ স্পিকার স্যারও বলে ফেলতেন। তবে সাবেক স্পিকার সুমিত্রা মহাজনকে নিয়মিতভাবে স্যার বলতেন উত্তর প্রদেশের সাংসদ ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সন্তেষ গাঙ্গোয়ার।
পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসনের এক সাবেক সর্বোচ্চ কর্মকর্তা সাংবাদিককে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে একটি দামী কথা বলেছেন। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই একজন করে পুরুষ আছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই মূল্যবোধ গড়ে ওঠে। ফলে কোনো কোনো নারী অফিসারও নিজেদের স্যার হিসেবে দেখতে চান। ম্যাডাম হিসেবে নয়। তাকে ম্যাডাম বললে তিনি রেগে যান। তার ভিতরের পুরুষটি রেগে যায়। ওই পুরুষ আসলে সমাজ লালন করছে দীর্ঘদিন ধরে। যতদিন সমাজের বদল না হবে, ততদিন ম্যাডাম স্যারের আশ্চর্য সম্বোধন শুনে যেতে হবে। তবে এও ঠিক, নারীকে স্যার ডাকার কোনো নিয়ম ভারতীয় সংবিধানে নেই। এটা নিছকই সমাজ থেকে উঠে আসা রীতি।