বাংলাদেশের ১০ শতাংশ এলাকা তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা
৯ নভেম্বর ২০০৯আন্তর্জাতিক সমঝোতার মাধ্যমে গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন প্রয়োজনীয় মাত্রায় হ্রাস করতে ব্যর্থ হলে এ শতাব্দীর শেষ নাগাদ বিশ্বের তাপমাত্রা ৪ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে৷ শুধু তাই নয় উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে সুমেরু অঞ্চলে গলতে শুরু করেছে হিমবাহ, যার অবধারিত পরিণতি সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি৷ আর তা এখন সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্ব নেতৃত্বের সামনে৷ আর এই পরিবর্তন সৃষ্টি করবে উদ্বাস্তু মানুষ৷ যাকে বলা হচ্ছে জলবায়ু উদ্বাস্তু৷
জলবায়ু উদ্বাস্তু বলতে সাধারণভাবে এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়ে থাকে যিনি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কোনো না কোনো কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন৷ এ সবের মধ্যে রয়েছে খরা প্রবণতা বৃদ্ধি, নদীর ভাঙন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, হারিকেন, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা বা টর্নেডো ইত্যাদি৷ যুদ্ধ বা সংঘাতের কারণে বাস্তচ্যুত মানুষের তুলনায় জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিজনিত কারণে বেশি সংখ্যক মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছেন, তারা সারা জীবনের জন্য তাদের ভিটেমাটি, চাষের জমি ও জীবনধারণের উপায় হারিয়ে ফেলছেন৷
গ্রীনহাউস গ্যাস বায়ুমন্ডলে পুঞ্জিভূত হওয়ার ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সমুদ্রস্ফীতি ঘটতে শুরু করেছে৷ আন্ত:রাষ্ট্রীয় জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেল (আইপিসিসি)-এর ২০০৭ সালে প্রকাশিত চতুর্থ মূল্যায়ন থেকে জানা যায়, এটি প্রায় নিশ্চিত যে, বিগত শতাব্দীর শেষ দিকের তুলনায় বর্তমান শতাব্দীর শেষ নাগাদ বিশ্বের গড় উষ্ণতা ১ দশমিক ৮ ডিগ্রি থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সমুদ্রস্ফীতি ১৮ সেন্টিমিটার থেকে ৫৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বেড়ে যাবে৷ দেখা যাচ্ছে, মনুষ্যসৃষ্ট এই জলবায়ু পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে এবং দ্রুততর হচ্ছে৷ এর ফলে সারা বিশ্বেই বিরূপ প্রভাব পড়বে তবে দরিদ্র দেশসমূহই বেশি আক্রান্ত হবে বলে আশঙ্কা৷ গঙ্গা-ব্রক্ষ্মপুত্র-মেঘনা এই তিনটি বৃহৎ নদী অববাহিকার সর্বনিম্নে অবস্থিত বাংলাদেশের এক বিশাল অংশ সমুদ্র থেকে সামান্য উঁচুতে অবস্থিত৷ অত্যন্ত ঘনবসতির (প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ১০০০ জন) এদেশে দারিদ্র্য প্রকট, জনসক্ষমতায় ঘাটতি ব্যাপক, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাও ব্যাপক, এবং সমন্বিত উন্নয়ন ও জলবায়ু নীতি ও ব্যবস্থাপনা কাঠামোর বিভিন্ন দিক অনুপস্থিত অথবা দুর্বল৷
এছাড়া তিনটি অববাহিকায় বছরে যত পানি উৎপাদিত হয় তার ৯২ শতাংশ বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে আর এদেশের দীর্ঘ উপকূল এবং দেশের অভ্যন্তরে অনেক নিম্নাঞ্চল রয়েছে৷ এসমস্ত কারণেই বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন-উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম৷ জার্মান ওয়াচ-এর 'বৈশ্বিক জলবায়ু সংক্রান্ত ঝুঁকির সূচক ২০০৮' থেকে দেখা যায়, প্রাকৃতিক ক্ষয়-ক্ষতির কারণে ১৯৯৭-২০০৬ সময়ের বিবেচনায় পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ দশটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়৷ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পাঁচটি দেশ যথাক্রমে: হন্ডুরাস, নিকারাগুয়া, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম ও ডোমিনিকান রিপাবলিক৷ বাংলাদেশে ২০০৭-এ দুটি বিধ্বংসী বন্যা ও একটি খুবই শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ঘটে গেছে৷ এগুলো সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই ঘটেছে একথা বলা না গেলেও, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে এগুলোর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক যে রয়েছে তা জোর দিয়ে বলা যায়৷ ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশে অতিবৃষ্টি ও বন্যা, মারাত্মক ঘূর্ণঝড় এবং কোনো কোনো অঞ্চলে খরা আরো ঘনঘন ঘটবে তা প্রায় নিশ্চিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷
সমুদ্রস্ফীতির ফলে উপকূলীয় বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়তে পারে এবং প্রবল বন্যার কারণে নদীর আরো ব্যাপক ভাঙন ঘটবে; ফলে লাখো মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পড়বে৷ বাংলাদেশে একদিকে কৃষি জমি কমে যাচ্ছে এবং অপরদিকে ২০৫০ সাল নাগাদ কৃষিখাতে উৎপাদনক্ষমতা অনেক কমে যাবে বলে আইপিসিসির মূল্যায়ন থেকে প্রতীয়মান হয়৷ ফলে যেমন চলছে তেমন চলতে থাকলে এই শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ বাংলাদেশে এক ভয়াবহ রকমের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিবে৷ বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশে ফসল, ঘরবাড়ি, অবকাঠামো ঘন ঘন ধ্বংস হওয়ার ফলে একদিকে ত্রাণ ও পুনর্বাসনে ব্যস্ততা ও সম্পদ ব্যয় বাড়বে এবং অপরদিকে দেশে উন্নয়ন ব্যাহত হবে৷ দরিদ্র মানুষ নিঃস্ব এবং অদরিদ্র দরিদ্র হতে থাকবে৷ বাংলাদেশে জীববৈচিত্র্য দ্রুত নষ্ট হতে শুরু করেছে; ভবিষ্যতে তা আরো দ্রুত ও ব্যাপকভাবে ঘটতে পারে৷ কাজেই পরিবেশ ও অর্থনীতি ক্রমবর্ধমান সংকটের মুখোমুখি হতে থাকবে৷
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের সামনে এখন বিরাট চ্যালেঞ্জ৷ ২০১৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জনসংখ্যা বাড়বে ৫০ শতাংশ৷ আর ২০২০ সাল নাগাদ সমুদ্রে পানির উচ্চতা এমন পর্যায়ে পৌঁছবে যার ফলে বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ এলাকা অধিক হারে বন্যার ঝুঁকিতে পড়বে৷ বাংলাদেশের ওপর সম্পাদিত গবেষণা থেকে জানা গেছে, ২০৩০ ও ২০৫০ সাল নাগাদ বর্তমানের তুলনায় বার্ষিক গড় তাপমাত্রা যথাক্রমে ১ ও ১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২১০০ সাল নাগাদ ২.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেতে পারে৷
একই সঙ্গে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ২০৩০ ও ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বর্তমানের তুলনায় যথাক্রমে ১৪ ও ৩২ সেন্টিমিটার এবং ২১০০ সাল নাগাদ ৮৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে৷ এর ফলে বাংলাদেশের কমপক্ষে ১০ শতাংশ এলাকা সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে৷ যার ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পড়বেন বলে অনুমান করা হচ্ছে৷ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৬৭ সেন্টিমিটার বাড়লে গোটা সুন্দরবনই পানিতে তলিয়ে যাবে৷ ইতিমধ্যে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে অবস্থিত 'লোহাচরা'ও 'সুপারিভাঙ্গা নামের দুটি দ্বীপ হারিয়ে গেছে৷ লোহাচরা দ্বীপের মাত্র ১ মাইল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত প্রায় দেড় লাখ জনসংখ্যার 'সাগরদ্বীপের ৩৩.৬২ বর্গকিলোমিটার এলাকা গত ৩০ বছরে সমুদ্রে তলিয়ে গেছে৷ বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ভোলা দ্বীপও গত চার দশকে প্রায় ৩ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা হারিয়ে বর্তমানে ১৯৬৫ সালের তুলনায় অর্ধেকে এসে দাঁড়িয়েছে৷
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি ফল হিসেবে বাংলাদেশে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, বন্যা, খরা এবং ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানছে৷ গত বছরের প্রবল বন্যা ও ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডরে ফসল এবং অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২.৮ বিলিয়ন ডলার৷ যে কারণে সারা বছরই দেশে লেগেছিল খাদ্য সমস্যা ও পণ্যের উচ্চ মূল্য৷
নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ইউনাইটেড নেশনস ইন্টার-গভর্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেইন (আইপিসিসি) আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মোট ভূমির শতকরা ১৭ ভাগ সমুদ্র গ্রাস করে নেবে৷ এর ফলে অন্তত ২০ মিলিয়ন মানুষ হয়ে পড়বে গৃহহীন৷ সমুদ্র গ্রাস করে নেয়ার ফলে বাংলাদেশের যে সব অঞ্চল ছেড়ে এরই মধ্যে লোকজন চলে যেতে বাধ্য হয়েছে বিজ্ঞানীরা এবং আইপিসিসি তাদের বাংলাদেশের প্রথম জলবায়ু শরণার্থী বলে অভিহিত করা হয়েছে৷ উপকূলবর্তী নিচু ভূমিগুলো ক্রমেই সমুদ্র গ্রাস করে নেয়ায় পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটবে বলে তারা ইতিমধ্যে সতর্ক করে দিয়েছে৷
প্রতিবেদক: সাগর সরওয়ার
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক