অন্য অনেক দেশের যা জানতে অনেক দিন লেগেছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা হয়নি৷ চারদিনের মধ্যেই টেস্ট ক্রিকেট পুরো বিপরীত দুই রূপ দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশকে৷ প্রথম ইনিংসে ৪০০ রান করে বাকি ক্রিকেট বিশ্বের সঙ্গে নিজেদেরও চমকে দেওয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৯১ রানে অলআউট! বৈপরীত্য আর কাকে বলে!
উনিশ বছর কেটে যাওয়ার পরও মনে হয়, টেস্ট ক্রিকেটের রহস্যময়তার সঙ্গে বাংলাদেশের পরিচয়পর্ব এখনো শেষ হয়নি৷ এই ভালো তো এই খারাপ! কথাটা লিখেই মনে হলো, এভাবে ভালো আর খারাপ এক নিঃশ্বাসে বলাটা কি ঠিক হলো? ‘ভালো' তো আঙুলের কড়ে গুনতে শুরু করতে না করতেই শেষ আর ‘খারাপ' যেন অনিঃশেষ৷
মাঝখানে কিছুদিন একটু খারাপ করতেই বাংলাদেশের টেস্ট খেলার যোগ্যতা বা অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলে ফেলত ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার গণমাধ্যম৷ গত কিছুদিন আর তোলে না৷ তবে বাংলাদেশে প্রশ্নটা এখনো বাতাসে ঘুরপাক খায়, যেমন খাচ্ছে ভারতের বিপক্ষে ইন্দোর টেস্টে তিন দিনেই ইনিংস ব্যবধানে পরাজয়ের পর থেকে৷ উপমহাদেশে প্রথম বলে ‘ঐতিহাসিক' মর্যাদা পেয়ে যাওয়া কলকাতার দিবা-রাত্রির টেস্টের আগে তাই রোমাঞ্চের চেয়ে আশঙ্কার চোরাস্রোতই বেশি বয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেটের শিরদাঁড়া বেয়ে৷ ইন্দোরে ঝকঝকে রোদেই যেখানে ভারতীয় পেসাররা বল অমন সুইং করিয়েছেন, সেখানে সন্ধ্যার পর গোলাপি বলে তাঁরা না জানি কী করেন!
বাংলাদেশের জন্য টেস্ট ক্রিকেট আবার না পরিণত হয় নিষ্ঠুরতার আরেক নামে৷
টেস্ট ক্রিকেট স্বভাবগতভাবেই নিষ্ঠুর৷ ওভার নির্দিষ্ট ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টিতে অনেক সময় ফাঁকিজুকি দিয়ে পার পাওয়া যায়, আড়াল করে রাখা যায় অনেক ঘাটতি, কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে সে সবের সুযোগ নেই৷ নামটা একেবারে যথার্থ৷ টেস্ট ক্রিকেট মানে আক্ষরিক অর্থেই ‘টেস্ট'৷ শুধু ক্রিকেটীয় দক্ষতারই নয়, শারীরিক ও মানসিক শক্তিরও৷ শুধুমাত্র মাঠে নামা ১১ জন নয়, একটা দেশের ক্রিকেটীয় সংস্কৃতি টেস্ট উপযোগী না হলে যেটি জয় করা খুব কঠিন৷
টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের মূল সমস্যাটাও এখানেই৷ এই দেশের ওয়ানডেবান্ধব ক্রিকেট সংস্কৃতি তরুণ ক্রিকেটারদের মনে টেস্ট ক্রিকেটে ভালো করার স্বপ্ন বুনে দেয় না৷ এ দেশের ঘরোয়া ক্রিকেট কাঠামো টেস্ট ক্রিকেটের উপযোগী ক্রিকেটার তৈরি করার মতো যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নয়৷
খুঁজলে এমন আরো অনেক কারণ পাওয়া যাবে৷ তার আগে বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস নিয়ে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার কটাক্ষ একটু কমে যাওয়ার কারণটা মনে করিয়ে দিই৷ সেটি খুবই সরল৷ বাংলাদেশের কাছে টেস্টে হারা৷ কোনো দলের কাছে হারলে তো আর সেই দলের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় না৷ ঐতিহ্য আর আভিজাত্যের গর্বে নাক যতই উঁচু থাক না কেন, এটুকু ভদ্রতাবোধ অন্তত ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার আছে৷
ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওই দুটি টেস্ট জয় পরপর দুই বছরে— ২০১৬ ও ২০১৭ সালে৷ দুটিই মিরপুরে এবং দুটিই একই ফর্মুলা অনুসরণ করে৷ প্রথম দিন থেকেই বল ঘোরে, এমন টার্নিং ট্র্যাকের কল্যাণে, যা ব্যাটসম্যানশিপের চূড়ান্ত পরীক্ষা নেয়৷ বলতে পারেন, ব্যাটিংটা অনেকটাই পরিণত হয় ‘লটারি'তে৷ বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদেরও তো এমন উইকেটে ব্যাটিং করার অভ্যাস নেই৷ এ কারণে টেস্ট জিতলেও বাংলাদেশের সিরিজ জেতা হয়নি৷ ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া একটি টেস্ট যেমন হেরেছে, তেমনি জিতেছেও একটি৷ বাংলাদেশের অতীত ইতিহাসের কারণে সিরিজ ড্র করাই বিবেচিত হয়েছে বড় বিজয় বলে৷ ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুই জয়ের মাঝখানে শ্রীলঙ্কায় নিজেদের শততম টেস্টটিও জয়ের রঙে রাঙিয়েছিল বাংলাদেশ৷ শ্রীলঙ্কার মাটিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয় সবসময়ই একটু বাড়তি মর্যাদা দাবি করে৷ সব মিলিয়ে ওই বছরখানেক সময়ে মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশ মনে হয় টেস্ট ক্রিকেটটা একটু খেলতে শিখে গেছে৷
সেই ধারণার ধাক্কা খেতেও সময় লাগেনি৷ বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে সবচেয়ে স্মরণীয় ওই তিন জয়ে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবালের৷ বাকিদের টুকটাক অবদান তো ছিলই, তবে বলতে গেলে জয়ের আশি ভাগ কৃতিত্বই পাওনা ছিল এই দুজনের৷ তা যেকোনো দলেই তো সিনিয়র খেলোয়াড়দের ওপর এমন নির্ভরতা থাকে৷ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সমস্যাটা হলো, এই দুজনের অভাব অর্ধেক পূরণ করতে পারেন, এমন কেউ নেই৷
ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয় যদি বাংলাদেশের কপালে জয়টীকা হয়, সেটির পাশেই কলঙ্কের দাগ এই গত সেপ্টেম্বরে আফগানিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট হেরে বসা৷ পরাজয়েরও তো ধরন থাকে৷ বৃষ্টির কল্যাণে ড্র একরকম নিশ্চিত হয়ে যাওয়া টেস্ট বাংলাদেশ যেভাবে হারতে সক্ষম হয়েছে, সেটি একইসঙ্গে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে অনেক কিছু নিয়ে৷ দক্ষতা, সামর্থ্য, মানসিকতার সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের টেস্ট খেলার আগ্রহও চলে এসেছে আতশ কাচের নিচে৷
চট্টগ্রামে সেই টেস্টে লজ্জাজনক পরাজয়ের পর সংবাদ সম্মেলনে এই পরাজয়ের সূত্র ধরে চলে আসা বাংলাদেশের ক্রিকেটের নানারকম সমস্যা নিয়ে প্রশ্ন করায় অধিনায়ক সাকিব আল হাসান মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘‘হারলেই শুধু এসব নিয়ে কথা হয়৷''
এ কথা বলে সাকিব সমস্যাগুলোকে অস্বীকার করেননি৷ বোঝাতে চেয়েছেন, হারার পর সমস্যাগুলো আলোতে এলেও কদিন পরই তা আবার হারিয়ে যায় অন্ধকারে৷ কথাটা মিথ্যা নয়৷ টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের সমস্যার কারণ খুঁজতে গেলে এমন অনেক কিছু আসবে, যা গত ১৯ বছর ধরেই আলোচিত হচ্ছে৷ কিন্তু ওই আলোচনা পর্যন্তই, সমাধান আর হয়নি৷
এক নম্বরে আসবে ঘরোয়া ক্রিকেট৷ বাংলাদেশের ঘরোয়া ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট প্রসঙ্গে এখনো ‘পিকনিক' ক্রিকেট কথাটা ব্যবহৃত হয়৷ আগের তুলনায় কিছুটা উন্নতি তো হয়েছেই, তবে এখনো সেটি টেস্ট ক্রিকেটের জন্য ক্রিকেটারদের প্রস্তুত করতে পারে, প্রতিদ্বন্দ্বিতার এমন পর্যায়ে পৌঁছাতে ব্যর্থ৷ উইকেট নিয়ে আলোচনাও টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের সমান বয়সি৷ বেশির ভাগ এমন উইকেটে খেলা হয়, যেখানে পেস বোলারদের জন্য কিছুই থাকে না৷ শুরুতে কয়েক ওভার বোলিং করার পর পেসাররা তাই পরিণত হন শুধুই ফিল্ডারে৷ সেই পেসার যখন টেস্ট ক্রিকেটে সুযোগ পাবেন, দিনে ১৫/১৬ ওভার, কখনো এর চেয়েও বেশি বোলিং কীভাবে করবেন? তাঁর তো এই অভ্যাসই নেই৷
ক্রিকেটারদের মধ্যে আত্মনিবেদনের অভাব আছে৷ তবে এরও অনেকটা দায় ওই ক্রিকেট কাঠামোর৷ ফার্স্ট ক্লাস পর্যায় থেকেই পেশাদারিত্বে যে দীক্ষা নেওয়ার কথা, সেটি হচ্ছে না৷ আরেকটু নীচের পর্যায়ে উঁকি দিলে তো গা শিউরে ওঠে৷ তরুণ ক্রিকেটারদের সূতিকাগার ঢাকার প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ লিগে চলে পাতানো খেলার মচ্ছব৷ কোন খেলায় কে জিতবে, এটিই শুধু নয়; কতক্ষণে জিতবে, সেটিও পর্যন্ত ঠিক হয়ে থাকে আগে থেকেই৷ এই অপসংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠা ক্রিকেটাররা যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখবে, তারাও তো সাফল্যের জন্য শর্টকাটই খুঁজবে৷ আর টেস্ট ক্রিকেটে যে কোনো শর্টকাট নেই, সেটি কে না জানে!
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷