বাংলাদেশ যা চায়, মিয়ানমার তা চায় না
৮ নভেম্বর ২০১৭রাখাইন প্রদেশে নির্যাতন হয়, গ্রামের পর গ্রাম পুড়ে ছাই হয়, ধর্ষণের শিকার হয় অসংখ্য নারী – এ সব বিষয়ে তেমন কোনো বক্তব্য নেই মিয়ানমারের৷ নেই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশমুখী স্রোত বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ৷ সীমান্ত খোলা৷ কোনো প্রহরা নেই৷ যার খুশি যেতে পারো৷ কিন্তু যাঁরা দেশ ছাড়ছেন, তাঁদের ফেরার কী উপায়? আপাত দৃষ্টিতে কোনো উপায়ই নেই৷ বরং কেউ যাতে ফিরতে না পারে সেরকম উদ্যোগও আমরা দেখেছি৷ মিয়ানমার সেনাবাহিনী তো বাংলাদেশসীমান্তসংলগ্ন এলাকায় মাইনও পুঁতেছে!
সংকট ঘণীভূত হওয়ায় একটু দেরিতে হলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের টনক নড়তে শুরু করেছে৷ তার সর্বশেষ প্রমাণ নিরাপত্তা পরিষদের এক বিবৃতি৷ সোমবার এক বিবৃতিতে নিরাপত্তা পরিষদ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে৷ আরো বলেছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী যেন রাখাইন প্রদেশে আর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ বন্ধ করে৷ রাখাইনে বেসামরিক প্রশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন নিশ্চিত করা এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্যও সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে বিবৃতিতে৷
এই বিবৃতিতে মিয়ানমার চরম নাখোশ৷ সে দেশের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির দপ্তর বুধবার পাল্টা বিবৃতিতে বলেছে, নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতিটি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে চলমান আলোচনার জন্য ‘মারাত্মক ক্ষতিকর' হতে পারে৷ তাদের দাবি, রোহিঙ্গা সংকটের নিরসন যে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমেই সম্ভব, সেই বিষয়টিকে গুরুত্বই দেয়নি নিরাপত্তা পরিষদ৷
সুতরাং, এটা পরিষ্কার যে, মিয়ানমার চায় না, রোহিঙ্গা ইস্যুতে তৃতীয় কোনো পক্ষ তাদের ওপর কোনোভাবে চাপ প্রয়োগ করুক৷ কিন্তু চাপ ছাড়া আপনা-আপনি তারা সংকট নিরসনে উদ্যোগী হবে না – এ বিষয়টি বুঝতে পেরে বাংলাদেশ সরাসরিই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছে৷ গত রোববারও কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর সংসদ সদস্যদের এক সম্মেলনে এ আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷
বাংলাদেশ বুঝতে পারছে, চাপ ছাড়া মিয়ানমারকে নড়ানো যাবে না৷ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা গত কয়েক বছরের নিষ্ফল দ্বিপাক্ষিক আলোচনার প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, ‘‘বছরের পর বছর ধরে আমরা এই সংকট দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমেই নিরসন করার চেষ্টা করেছি৷ কোনো কাজই হয়নি৷ এখন আমরা মনে করি, সংকট নিরসনের প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের সম্পৃক্ততা অত্যাবশ্যক৷''
কিন্তু মিয়ানমার বলছে উলটো কথা৷ তারা মনে করে, জাতিসংঘের এ বিষয়ে কোনো বিবৃতি দেয়াও অনধিকার চর্চার মতো৷
অন্যদিকে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ক্ষেত্রেও কি মিয়ানমার খুব আন্তরিক? সু চির এক মুখপাত্রের সাম্প্রতিক বক্তব্য কি তা প্রমান করে? সেই মুখপাত্রের মতে, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চায়, কিন্তু বাংলাদেশ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিদেশি সাহায্যের লোভে অহেতুক বিলম্ব করছে৷
অকথ্য নির্যাতনের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য হলো ছয় লাখেরও বেশি মানুষ৷ তাদের ফিরিয়ে নেয়ার অঙ্গীকারের পাশাপাশি কি শর্ত দিয়েছে মিয়ানমার? বলেছে, যাঁরা প্রমাণ দেখাতে পারবেন যে সত্যিই রাখাইনে দীর্ঘকাল ছিলেন, তাঁদেরই ফিরিয়ে নেয়া হবে৷ তা যে দেশ তাঁদের নাগরিক হিসেবেই স্বীকার করে না, সে দেশের ‘পরিচয়পত্র' কি রোহিঙ্গারা গুরুত্ব দিয়ে সংরক্ষণ করতো? যদি করেও থাকে, প্রাণ রক্ষার জন্য যখন ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে, সঙ্গে করে আনতে পেরেছে? অধিকাংশের কাছেই তো সেই ‘পরিচয়পত্র' থাকার কথা নয়৷ না থাকলে চিহ্নিত করার উপায়?
মিয়ানমার মনে করে, রাখাইনে যাঁরা আছেন, তাঁদের মতামত এক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়া উচিত৷ তো যাঁরা আছেন, তাঁরা কি রোহিঙ্গাবান্ধব? যদি না হয়?
এ সব বিষয় পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত কি বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ শুরু করতে পারে?
আপাতত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, খুব সঙ্গত কারণে বাংলাদেশের তাতে আপত্তি থাকলেও মিয়ানমার ঠিক তা-ই চায়৷ তারা চায়, বাংলাদেশ সবদিক বিবেচনা না করে, সব সম্ভাবনা আর আশঙ্কার দিকগুলো ভালো করে খতিয়ে না দেখেই প্রত্যাবাসন শুরু করুক৷ শুরু করে দিলে আন্তর্জাতিক চাপটা কমে আসবে৷ প্রত্যাবাসন শুরুর পর যদি সংকট দেখা দেয়, তাহলে আবার আলোচনার নামে সময় নষ্ট করা যাবে৷
আসলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার যা করছে, তাকে অমানবিক অপকৌশল ছাড়া কিছুই বলা যায় না৷ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে তাদের আন্তরিকতার খুব উল্লেখযোগ্য নিদর্শন একেবারেই নেই৷ দ্বিপাক্ষিক আলোচনা, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরুর আগেই একদিকে সু চির মুখপাত্র এবং অন্যান্য মহল বাংলাদেশের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, অন্যদিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ বা তৃতীয় কোনো পক্ষের ভূমিকাকে মনে করা হচ্ছে অপ্রয়োজনীয়৷
বাংলাদেশ চাইলেও মিয়ানমার কি সত্যিই চায়, রোহিঙ্গারা দেশে ফিরে যাক?