প্রান্তিক জাতি, প্রান্তিক ভাষা
৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬কলকাতার প্রখ্যাত ইংরেজি পণ্ডিত সুকান্ত চৌধুরীর সঙ্গে একবার কোন সূত্রে জানি না, কথা হচ্ছিল শেক্সপিয়ার বড় না রবীন্দ্রনাথ বড়, সেই পুরনো প্রসঙ্গ নিয়ে৷ আমি বলছিলাম আমার পরলোকগত পিতৃদেবের কাছে শোনা একটি কাহিনির কথা৷ গ্রিক দার্শনিক প্লেটো নাকি একবার বলেছিলেন, ‘‘আমি যদি একটি জাতের গান লিখতে পারি, তাহলে কে সেই জাতের আইনকানুন তৈরি করে, তা জেনে আমার কী হবে?'' রবিঠাকুর কি ঠিক তাই করেননি?
অপরদিকে রবিঠাকুর নিজে বলে গিয়েছেন, শেক্সপিয়ারের যশসূর্য মধ্যগগনে উঠতে বেশ কয়েক শতাব্দী সময় লেগে গেছে৷ কবি কি পরোক্ষভাবে বলার চেষ্টা করছিলেন, কালে তাঁর যশসূর্যও অনুরূপভাবে মধ্যগগনে উঠবে? কিন্তু সুকান্ত স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, বাংলা হাজার হলেও একটি ‘মার্জিনাল', অর্থাৎ প্রান্তিক ভাষা৷ কাজেই এক হিসেবে বাংলা যেমন কোনোদিনই ইংরেজির জায়গা নিতে পারবে না, সেইরকম রবীন্দ্রনাথের পরিচিতিও কোনোদিন শেক্সপিয়ারের খ্যাতিকে ছুঁতে পারবে না৷ না, সুকান্ত অবশ্যই সেরকম কিছু বলেননি, অন্তত অতটা খোলসা করে নয়৷ কিন্তু মানেটা তাই দাঁড়ায় বটে৷
আসল কথা হলো, ঐ ‘প্রান্তিক' কথাটা তার পর থেকে আমার মাথায় আটকে রয়েছে, বিশেষ করে প্রবাসী জীবনে, তা কোলনে দুর্গোৎসবেই হোক আর টরন্টোয় বাংলাদেশি শাড়ির দোকানেই হোক৷ আমরা বাঙালিরা প্রান্তিক৷ জার্মানির পথেঘাটে বাঙালি খুব বেশি চোখে পড়ে না৷ কাজেই এখানে মানুষজন আমাকে কখনো শ্রীলঙ্কার তামিল, কখনো ভারতের বিহার বা উত্তর প্রদেশের মানুষ বলে ধরে নেন৷ বাঙালি যারা চেনেন, তারা চেনেন প্রধানত বাংলাদেশি বাঙালিদের৷ সাধারণভাবে আমার বাঙালি পরিচয়টাও মোটামুটি ঐ বাংলাদেশি পরিচয়টার সঙ্গেই মিশে গেছে, এক ধর্ম কিংবা পুজো-আচ্ছার সময়টা বাদে – আর আমি প্রান্তিক থেকে প্রান্তিকতর, এমনকি প্রান্তিকতম হয়ে পড়েছি বা পড়ছি৷
তাহলে দেশে – মানে এপার কিংবা ওপার বাংলায়, বিশেষ করে ওপারে – সংখ্যালঘু এমন একটা গুরুতর শব্দ, এমন একটা গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো কেন? খেয়াল করে দেখলাম, জার্মানিতে আমরা বাঙালিরা – তা সে এপারেরই হোন আর ওপারেরই হোন – আমার সংখ্যায় লঘু না হয়ে যেন লঘিষ্ঠ! কাজেই এ দেশে বাঙালিদের নিয়ে আলাদা করে সমস্যা না বানিয়ে, তাদের আপামর বিদেশি-বহিরাগতদের পর্যায়ে ফেলে দেওয়া হয়৷ কোলন রেলওয়ে স্টেশনে হুলিগ্যান আর নব্য-নাৎসিরা যখন জুৎসই করে ঠেঙানোর মতো ‘উদ্বাস্তু' খোঁজে, তখন তাদের জালে মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ, উত্তর আফ্রিকার মানুষ, পাকিস্তানি না ভারতীয় না বাংলাদেশি ঠিক কি উঠল, সেটা বিচার করে দেখার মতো বিদ্যে বা বুদ্ধি, দু'টোর কোনোটাই তাদের মতো সরল মনিষ্যিদের নেই৷ ব্রিটেনে ‘পাকি ব্যাশিং'-এর সময়েও ছিল না৷ তাহলে হঠাৎ বাংলাদেশে বা পশ্চিমবঙ্গেই বা ব্যাপারটা এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে কেন?
হয়ে দাঁড়ানোর পিছনে দু'টি কারণ আছে, যেমন চিরকালই থাকে: ইতিহাস ও সত্তা৷ বঙ্গদেশের ইতিহাস প্রথমে মুসলিম আধিপত্য ও পরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ইতিহাস৷ হিন্দু বাঙালিরা যে প্রথমটির তুলনায় দ্বিতীয়টিকেই পছন্দ করেছেন, তা-ও বোধগম্য৷ যা বোধগম্য নয়, তা হলো টেকচাঁদ ঠাকুর, কালীপ্রসন্ন সিংহ থেকে শুরু করে বঙ্কিমচন্দ্র, গিরীশচন্দ্র অবধি মুসলমানদের সম্পর্কে নানা তাচ্ছিল্যপূর্ণ মন্তব্য৷ হিন্দু জমিদার, মুসলমান প্রজা৷ বাঙালি বাবু, মুসলমান বাবুর্চি – কারা যেন যুগ যুগ ধরে দু'ধরনের, দু'টি ধর্মের বাঙালিদের মধ্যে ঘৃণা, অবজ্ঞা, ভয়-ভীতির বীজ বপন করে গেছে৷ আজ যখন শুনি নজরুল বনাম রবীন্দ্রনাথের মোহড়া চলেছে, তখন মনে পড়ে, আমার পিতৃদেব ছিলেন রবীন্দ্রভক্ত, আর তাঁর হোস্টেলে এসে অগ্নিবীণা বাজাতেন তাঁরই এক – হিন্দু – বন্ধু৷ সে বোধহয় অন্য এক বঙ্গ, অন্য এক বাংলা, অন্য এক বাংলাদেশ৷
ইতিহাস অথবা জাতিসত্তার বৃহৎ প্রেক্ষাপটে আমাদের ক্ষুদ্র বাঙালিত্বের ওজন এতটাই হালকা, যেন হাতির পিঠে মশা বসেছে৷ আমরা প্রান্তিক হয়ে পড়ি৷ আরেকভাবে বলি: ১৯১১ সাল; কলকাতা আর ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী, বিশ্বব্যাপী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার দ্বিতীয় শহর রইল না৷ কলকাতা প্রান্তিক হয়ে পড়ল৷ ঢাকার কথা আপাতত থাক৷
আমরা বাঙালিদের বুঝতে হবে, আমাদের প্রান্তিকতাই আমাদের বৈশিষ্ট্য, সেটাই আমাদের পরিচয়৷ উদাহরণ দিই: লন্ডনে একটি ছোট ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে খেতে ঢুকেছি গিন্নিকে নিয়ে৷ গিন্নি শ্বেতাঙ্গিনী, কথাবার্তা হচ্ছে জার্মানে৷ তারই মধ্যে রেস্টুরেন্টের মালিক একবার এসে টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে হেঁড়ে গলায় বললেন: ‘‘বাঙালি?'' কি করে বুঝলেন, তিনিই জানেন৷
আমার ঘাড়ে কটা মাথা যে ‘না' বলি?
আপনার কী কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷