1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাজারে দাম বেঁধে দেয়া কতোটা সম্ভব?

১১ মার্চ ২০২২

বাংলাদেশের নিত্যপণ্যের বাজার ক্রমশ অস্থির হচ্ছে, দাম দফায় দফায় বেড়ে চলেছে৷ গণমাধ্যমের প্রতিবেদনেও প্রায় প্রতিদিনই বাজারের এই উর্ধ্বগতি ও অস্থিরতার চিত্র উঠে আসছে৷

https://p.dw.com/p/48MAo
ছবি: DW

চাল, ডাল, ভোজ্য তেল, আলু, চিনি, পেয়াঁজ, আদা, বিভিন্ন রকম সবজি, আটা, ডিম, দুধসহ প্রায় সবধরণের খাদ্যপণ্য গত কয়েকমাস ধরে বিভিন্ন সময়ে ঘুরে-ফিরে বাড়তির দিকেই যাচ্ছে৷ 

বাড়তি দামের চাপে দেশের জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ পড়েছে কষ্টের মধ্যে৷ এদের বেশিরভাগেরই আয়-উপার্জন সীমিত৷ ফলে নিত্যদিনের জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে বরাবরই বেগ পেতে হয়৷ আর ক্রমাগত দাম বাড়ায় কষ্টের মাত্রাও বেড়ে যায়৷  দাম বাড়ার পরিধিটা বেশ বড় হওয়ায় জীবনযাপন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়৷ বাজারে শুধু খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লে তাও কষ্ট সয়ে কিছুটা সামাল দেয়ার চেষ্টা করা যেতো৷ কিন্তু খাদ্যের বাইরের পরিবহনের ব্যয় ও বাড়িভাড়া বেড়ে যাওয়ায় তা আর সম্ভব হচ্ছে না গরিব মানুষেরও মধ্যবিত্তে রপক্ষে৷

কেন দাম বাড়ছে? আর কেনই বা দাম বাড়ার গতিতে লাগাম টানা যাচ্ছে না? এ প্রশ্ন দুটোর সদুত্তর পাওয়া বেশ কঠিনই৷ অর্থনীতিবিদরা চাহিদার বিপরীতে সরবরাহের ঘাটতিকে দায়ী করছেন৷ ব্যবসায়ীরা বলছেন, কিছু পণ্যের দাম বৈশ্বিক বাজারে চড়া বলে বেশি দাম আমদানি করে আনতে হচ্ছে৷ ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ বাজারের সিন্ডিকেটকে দুষছেন, দুষছেন সরকারের অপর‌যাপ্ত পদক্ষেপকে৷  মন্ত্রীরা কেউ কেউ মনে করছেন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতার তুলনায় দ্রব্যমূল্য সেভাবে বাড়েনি৷ তাঁরা বরং বিশ্ববাজারের উচচ মূল্য ও অস্থিরতাকে প্রধান কারণ মনে করছেন৷ আর ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এখন যাবতীয় দায় এই যুদ্ধের ওপর চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছে৷

যে যাই বলুন না কেন, দাম বেড়ে যাওয়ার সংকট যে বেশ গভীর হয়ে গেছে, তা সরকারের একাধিক পদক্ষেপ থেকে স্পষ্ট৷ যেমন, আসন্ন রমজান মাস উপলক্ষে সারা দেশে এক কোটি পরিবাবরকে কমমূল্যে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবির) মাধ্যমে দুই দফায় সয়াবিন তেল, চিনি, ডাল, ছোলা, পেঁয়াজ ও খেজুর সরবরাহ করা হবে৷ এ জন্য  বিশেষ কার্ড  দেয়া হবে যা দেখিয়ে কার্ডধারীরা নিয়মিত বাজারদরের চেয়ে কমমূল্যে এসব পণ্য কিনতে পারবেন৷

এই ধরণের পদক্ষেপ নিয়ে নিম্নআয়ের ভুক্তভোগী মানুষকে সাময়িকভাবে কিছুটা স্বস্তি দেওয়া গেলেও মূল সমস্যার কোনো অর্থবহ সমাধান আসবে না৷ একইভাবে বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার দোহাই তুলে দেশের ভেতরের মূল্যবৃদ্ধিকে বৈধতা দেয়ার প্রয়াসটিও ইতিবাচক নয়৷ কোনো সন্দেহ নেই, বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে তার প্রভাব দেশের বাজারেও পড়তে বাধ্য৷ প্রশ্ন হলো, তা কতখানি ও কোনমাত্রায়? আজকে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের দাম বাড়লে আগামীকালই চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে খুচরা বাজারের ক্রেতাকে আগের দিনের চেয়ে বাড়তি দাম দিতে হবে কেন?

বিশ্ববাজারের দাম বাড়লে তার জের ধরে স্থানীয় বাজারে দাম বাড়ার পেছনে একাধিক বিষয় কাজ করে৷ স্থানীয় বিক্রেতারা আগাম মুনাফা তুলতে দাম বাড়িয়ে দেয়৷ তাদের যুক্তি হলো: আমদানিকারকরা আগামীতে যখন উচ্চদামে পণ্য আনবে, তখন তা উচ্চদামেই পাইকারী বাজারে ছাড়বে আর সেগুলোর দাম আরেকটু বেড়ে খুচরা বাজারে আসবে৷ তখন খুচরা বিক্রেতাকেও মুনাফা করতে দাম আরেকদফা বাড়াতে হবে৷ ফলে তারা দাম বাড়ালেও মুনাফার মাত্রা অপরিবর্তিতই থাকবে৷ কিন্তু বর্তমান যে মজুদ তাদের কাছে আছে, তা শেষ হয়ে গেলে আর কোনো কারণে পণ্য সরবরাহে আমদানি পর‌যায়ে বা পাইকারী বাজারে ব্যাঘ্যাত ঘটলে অনেক বিক্রেতার কাছেই তখন বিক্রয়যোগ্য পণ্য নাও থাকতে পারে৷ সে আশংকায় এখনই দাম বাড়িয়ে লোকসানের ঝুঁকি এড়ানো হয়৷ এভাবে শেষতক ভোক্তার ঘাড়ে বর্তমানের পাশাপাশি ভবিষ্যত দামের বোঝাও অনেকটা আগামভাবে চাপিয়ে দেয়া হয়৷

লক্ষণীয় বিষয় হলো, যে পণ্য এখনো আমদানি করাই হয়নি সেটার হালনাগাদ দামকে বিবেচনায় নিয়ে বর্তমান দাম হাঁকা হচ্ছে দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে৷ কিন্তু বিশ্ববাজারে দরপতন ঘটলে স্থানীয় বিক্রেতাদের যুক্তি উল্টে যায় এভাবে যে তারা আগে আমদানিকৃত বা মজুদকৃত পণ্য থেকে বি্ক্রি করছেন৷ আর যখন এসব আমদানি করা হয়েছিল, সেগুলোর দাম বেশি ছিল৷ বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই এই চর্চা চলছে৷

আবার বাংলাদেশে চাল ও গম ছাড়া আর কোনো খাদ্যপণ্য আমদানিতেও সরকারের কোনো ভূমিকা নেই বললেই চলে৷ টিসিবি যেসব পণ্য আমদানি করে, সেগুলোও বেসরকারি ডিলারদের মাধ্যমে করা হয়৷ ফলে, ভোগ্যপণ্য আমদানির প্রায় পুরোটাই বেসরকারিখাতের হাতে৷ আবার এদের মধ্যে অল্প কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান আমদানির বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে৷ সেজন্য অভিযোগ করা হয় যে কতিপয় বড় আমদানিকারক সিন্ডিকেট বা নিজেদের মধ্যে চক্র করে রেখেছে যাতে অন্য কেউ সেখানে ঢুকতে না পারে৷ আসলে, এটা ঠিক চক্র নয়, এটা হলো বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের তুলনামূলক প্রতিযোগিতা ও খরচ-সাশ্রয় করার সক্ষমতা যাকে অর্থনীতির পরিভাষায় বলে ইকোনমিজ অব স্কেল৷

তবে এই সক্ষমতার শক্তি যখন অনেক বেশি হয়ে যায়, তখন তা সমস্যা তৈরি করে৷ কেননা, সরকারের পক্ষেও একে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না৷ আর তাই বাজারে দাম ওঠা-নামায় এসব বড় প্রতিষ্ঠানই মূল নিয়ামক হয়ে ওঠে৷ এরাই পণ্যের দাম নির্ধারণ করে নিজেদের মুনাফা ঠিক রেখে৷

আসজাদুল কিবরিয়া, পরিকল্পনা সম্পাদক, দ্য ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেস
আসজাদুল কিবরিয়া, পরিকল্পনা সম্পাদক, দ্য ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেসছবি: Privat

এটাতো আমদানির দিক৷ আমদানির পর পাইকারী বাজার হয়ে খুচরা বাজারে পণ্য আসতে যে একাধিক স্তর পার হতে হয়, সেখানে দোকান ভাড়া ও পরিবহন ব্যয়ের মতো ব্যয়গুলো মিটিয়ে মুনাফা ধরে বিক্রয়মূল্য নির্ধারিত হয়৷ এক্ষেত্রে কিছু অদৃশ্য ব্যয় আছে যা দাম নির্ধারণে ভূমিকা রাখে৷ বিশেষত অবৈধ চাঁদাবাজি৷ এই অবৈধ চাঁদাবাজির বখরা নেয় এক শ্রেণীর পুলিশ, মাস্তান ও রাজনৈতিক নেতা৷ বিষয়টি ‘প্রকাশ্য গোপনীয়' বা ওপেন সিক্রেট৷ মূলত এক ধরণের রেন্ট সিকিং বা অনুপার্জিত আয়ের বড় ধরণের চক্র তৈরি হয়েছে এখানে যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ভোক্তার ওপর৷ সুশাসনজনিত ঘাটতির কারণে এটা বন্ধে বা নিয়ন্ত্রণে কারযকর পদক্ষেপের  অভাব প্রবল৷  অথচ তা করা গেলে দাম বাড়ায় কিছুটা হলেও লাগাম টানা যেতো৷ এদিকে মনোযোগ না দিয়ে  না করে শুধু আমদানি শুল্ক কমিয়ে বা সাময়িকভাবে ভ্যাট অব্যাহতি দিয়ে দাম তেমন একটা কমানো যাবে না৷

দাম নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন সময়ে ব্যবসায়ীদের সাথে বৈঠক করে৷ সেখানে কোনো কোনো পণ্যের সর্বোচ্চ দর ঠিক করাও হয়৷ বাস্তবে দেখা যায় যে সেটি আর ঠিক থাকে না৷ ফলে দর বেঁধে দেয়ার প্রয়াসটা বহুলাংশে ব্যর্থতায় পর‌যবসিত হয়৷ সরকারের পক্ষ থেকে ট্যারিফ কমিশন বিশ্ববাজার, স্থানীয় মজুদ ও চাহিদা পরিস্থিতি নিয়মিত বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন পণ্যের দাম কী হতে পারে, তার একটি প্রতিবেদন তৈরি করে আসছে কয়েক বছর ধরে৷  বাস্তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার চেয়ে বেশি দামে ভোক্তাদেরকে পণ্য কিনতে হয়৷ আর তাই সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন উঠে যে দাম বেঁধে দেয়া কী আদৌ সম্ভব?

আসলে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে এভাবে দাম বেঁধে দেয়া খুব বাস্তবসম্মত নয়৷ একইভাবে সম্ভব নয় ব্যবসায়ী-বিক্রেতারা কোন পণ্যে কতোটা বা কী হারে মুনাফা করবে, তা নির্ধারণ করা৷ বরং, পণ্য সরবরাহের বিভিন্ন ধাপে অবৈধ লেনদেন ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করা যৌক্তিক পদক্ষেপ৷ একইসঙ্গে বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন, আমদানি, চাহিদা ও দামের সঠিক ও বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত সরকারের হাতে থাকা আবশ্যক যেন এসব তথ্য নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণ করা যায়৷ সেই বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বিভিন্ন পণ্যের সম্ভাব্য বা নির্দেশক (বেঞ্চমার্ক) দাম নিয়মিত প্রকাশ ও প্রচার করা যেতে পারে৷ তাতে করে ভোক্তারা অন্তত এটা ধারণা করতে পারবেন যে তাঁরা কতটা বেশি দিয়ে কিনছেন৷ এতে করে সবধরণের বিক্রেতাদের ওপর একটা নৈতিক চাপও তৈরি হবে৷

সর্বোপরি দেশে যে বড় ধরণের আয়-বৈষম্য তৈরি হয়েছে, তাও প্রতিফলিত হচ্ছে উচ্চদামে তথা মূল্যস্ফীতিতে৷ মোট জনগোষ্ঠীর তুলনায় আনুপাতিক হারে অনেক কম হলেও একটা বড় অংশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এতোটাই বেশি যে কোনো  ‍উচ্চমূল্যই তাদের কাছে বাধা নয়৷ এরা বরং সামগ্রিক চাহিদা বাড়াতে ভূমিকা রাখছে যার প্রভাব পড়ছে দামে, বাড়ছে ব্যয়ের বৈষম্যও৷ অন্তত সাদাচোখে তাই দেখা যাচ্ছে৷

২০২১ সালের ছবিঘর