‘লাম্পেডুসা ক্যাম্প'
১৭ অক্টোবর ২০১৩লাম্পেডুসায় এখনও সাগর থেকে লাশ তোলা হচ্ছে৷ ইউরোপের উঁচু উঁচু কর্মকর্তা সেখানে গিয়ে সমবেদনা জ্ঞাপন করে এসেছেন৷ লাম্পেডুসার ট্র্যাজেডি যে গোটা ইউরোপে একটা ইলেকট্রিক শকের মতো কাজ করেছে, সেটা তারা জানেন৷ লাম্পেডুসার স্থানীয় মানুষেরাই ব্রাসেলসের হর্তাকর্তাদের দুয়ো দিয়েছে৷ বার্লিনের ক্রয়েৎসব্যার্গ এলাকায় রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের প্রতিবাদ শিবিরটির নাম কিন্তু এক বছর আগেই ‘‘লাম্পেডুসা: বার্লিনের একটি গ্রাম'' রাখা হয়েছিল৷
একটি রোদ-বৃষ্টিতে ম্লান হয়ে আসা ব্যানারে আজও নামটি লেখা আছে৷ নয়ত ক্যাম্প বলতে কিছু ক্যানভাসের তাঁবু, যার বাসিন্দারা সবাই উদ্বাস্তু: জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় পাবার পথ যেভাবে নিয়মকানুন আর বিধিনিষেধের প্রতিবন্ধকে কণ্টকাকীর্ণ করে রাখা হয়েছে, তারই বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন এই উদ্বাস্তুরা৷
‘লাম্পেডুসা গ্রাম'
ধূসর রঙের তাঁবুগুলোর গায়ে হাতে-কাচা জামাকাপড় শুকোতে দেওয়া আছে৷ একটি প্লাস্টিকের কফি ক্যানের পাশে একটি প্যাকিং বাক্সে ছোট ছোট সবুজ আপেল রাখা আছে৷ একটি তাঁবুতে দৃশ্যত কিচেন: সেখানে না-ধোয়া প্লেট আর বৃষ্টির জলে ভিজে যাওয়া পাঁউরুটি ডাঁই করা আছে৷ একটি গাছের নীচে দাঁড়িয়ে দু'জন লোক কথা বলছে৷ এরাও লাম্পেডুসার কাছে যাদের সলিলসমাধি ঘটেছে, তাদের মতো ‘বোট পিপল' হয়েই ইউরোপ তথা জার্মানিতে এসেছে৷ ‘‘কোনো বড় জাহাজডুবি না হলে তো আর আপনারা সাংবাদিকরা আসেন না,'' উক্তি করল দু'জনের একজন৷
বার্লিনের ‘লাম্পেডুসা গ্রামেই' থাকেন জনসন ওফোরে৷ ঘানার মানুষ৷ লাম্পেডুসার সাম্প্রতিক ট্যাজেডিতে জনসন তাঁর ভাই মাতি ওফোরেকে হারিয়েছেন৷ জনসন নিজে তার অনেক আগেই বার্লিনে পৌঁছতে সমর্থ হন৷ বোট দুর্ঘটনায় মাতি যেদিন প্রাণ হারান, সেদিন জনসন শত চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁর ভাইকে টেলিফোনে ধরতে পারেননি৷ নয়ত জনসন আগেও তাঁর ভাইকে বারংবার বলেছিলেন, অক্টোবরে সাগর খুব উত্তাল থাকে৷
ট্র্যাজেডি একটি নয়, একার নয়
নাইজিরিয়া থেকে আগত বশির-ও বলে, ‘‘ইউরোপ উদ্বাস্তুদের বাঁচানোর জন্য কিছুই করে না৷'' জনসনের ভাই মাতি ওফোরের ভাগ্যে যা ঘটেছে, বশিরের ভাগ্যেও তা ঘটতে পারতো৷ যে কারণে ২০১১ সালের ২৭ মে তারিখটিকে বশির কোনোদিনই ভুলতে পারবেন না৷ লিবীয় সৈন্যরা তাঁকে জোর করে ঠেলেঠুলে যে জাহাজটিতে তুলে দিয়েছিল, সে জাহাজটিও লাম্পেডুসার উপকূলেই ডুবে যায়৷ বশির প্রাণে বাঁচলেও, তাঁর দু'টি ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে বাঁচাতে পারেননি৷
৪৩ বছর বয়সি জনসন ওফোরে-ও তাঁর ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে বার্লিনে বসেই সারাদিন ধরে কেঁদেছেন৷ মাতির একটা ছবি পর্যন্ত তাঁর কাছে নেই৷ যা পড়ে আছে, সেটুকু শুধু স্মৃতি৷ যেমন সুদূর ঘানায় মাতির তিনটি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে বাবা কবে ইউরোপ থেকে টাকা পাঠাবে, তার আশায় বসে ছিল৷ কাজেই জনসনকে এখন জার্মানিতে কাজ খুঁজতে হবে, কাজ পেয়ে বাড়িতে টাকা পাঠাতে হবে৷ নয়ত মাতির তিন অনাথ ছেলেমেয়ের দেখা শোনা করবে কে?