বিএনপির নতুন রোড ম্যাপ, আওয়ামী লীগের কৌশল ‘ক্ষমা‘
২৪ জানুয়ারি ২০২৩একই সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিএনপি থেকে পদত্যাগ করে স্বতন্ত্র এমপি প্রার্থী "উকিল আব্দুস সাত্তার” কৌশল প্রয়োগেও সক্রিয় রয়েছে আওয়ামী লীগ।
বিএনপির নতুন রোডম্যাপ:
১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশকে সমানে রেখে বিএনপি নেতা-কর্মীরা যেভাবে উজ্জীবিত হয়েছিলো এখন তাতে কিছুটা হলেও ছন্দপতন হয়েছে বলে মনে করেন খোদ বিএনপি নেতারাই। তাই তারা আন্দোলনের নতুন রোডম্যাপ তৈরি ও প্রকাশ করে দলের নেতা-কর্মীদের চাঙা রাখতে চায়।
এরই অংশ হিসেবে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষদিকে ‘‘চলো চলো ঢাকা চলো'' রোড মার্চ এবং মার্চের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় মহাসমাবেশ করার পরিকল্পনা করছে দলটি। রমজানের আগেই চলমান আন্দোলনকে একটি ‘কাঠামোগত রূপ' দেওয়ার চিন্তা মাথায় রেখে কর্মসূচি চূড়ান্ত করছে তারা।
ফেব্রুয়ারিতে ‘‘মার্চ ফর ঢাকা'' কর্মসূচির মধ্য দিয়ে নেতাকর্মীদের সব ঢাকায় আনতে চান তারা। এরপর ঢাকায় একটি বড় মহাসমাবেশ করে আন্দোলনকে আরো একধাপ এগিয়ে নিতে চান ।
এজন্য বিএনপির শীর্ষ নেতারা দায়িত্ব ভাগ করে জেলার নেতাদের সঙ্গে ওয়ান টু ওয়ান কথা বলা শুরু করেছেন। যেখানে ঘাটতি আছে, সেখানে সাংগঠনিক নেতারা কাজ করবেন।
বিএনপি মনে করে, আন্দোলন দীর্ঘ হতে পারে। তাই নেতা-কর্মীরা যেন ক্লান্ত না হয়ে চাঙা থাকেন সেভাবেই কর্মসূচি ঠিক করা হচ্ছে। অনেকগুলো দল আর ছোট ছোট জোট বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে আছে। তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে তারাও যাতে তাদের সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে থাকেন সেই প্রক্রিয়াও চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। একইসঙ্গে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে যারা এখনো নিষ্ক্রিয় আছেন তাদের সক্রিয় করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
বিএনপি ধারাবাহিকভাবে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দেবে তবে কর্মসূচির নতুনত্ব ও ভিন্নতা থাকবে বলে বিএনপি নেতারা জানান।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, "১০ ডিসেম্বরের আগে বিএনপিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হতো। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বিএনপিকে মাজাভাঙা দল বলত। কিন্তু বিভাগীয় সমাবেশ শুরুর পর থেকেই মানুষের ব্যাপক উপস্থিতি তাদের ভীত করে। ঢাকার সমাবেশে তারা পতনের ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে। তাই বিএনপির সমাবেশে সব রকম বাধা দেয়। কিন্তু বিএনপি তার জনসমর্থন ও শক্তি প্রমাণ করেছে।”
তার কথা, "আন্দোলন সব সময় সমান তালে ও গতিতে চলে না। এটাও একটা কৌশল। মনে করেন আমরা এখন যে একটু ধীর লয়ে চলছি তার মধ্যেও কোনো উদ্দেশ্য আছে। আন্দোলনের কৌশল আছে। আমাদের আন্দোলনের ধারাবাহিকতা আছে। নতুন কৌশল আছে। সময় মতো সব কিছু দেখতে পাবেন।”
তিনি বলেন, "অনেকে মনে করছেন যে ডিসেম্বরে যেহেতু নির্বাচন তাই আমরা ডিসেম্বরকে টার্গেট করে আমরা আন্দোলন করছি। এটা নাও হতে পারে। সামনে ফেব্রুয়ারি মাস আমাদের জাতীয় জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস। এই মাসে একটা কিছু হয়ে যেতে পারে। মার্চ আরো গুরুত্বপূর্ণ। মার্চেও হতে পারে। যখন হবার তখন হয়ে যাবে।”
আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ক্ষমা
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের সামায়িক বরখাস্ত মেয়র মো. জাহাঙ্গীর আলমকে দলে ফিরিয়ে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। তাকে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে ফের বহাল করা হয়েছে। এর আগে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটুক্তির অভিযোগে তাকে ২০২১ সালের নভেম্বরে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। এরপর মেয়র পদও হারান তিনি। তার মেয়র পদ ফিরে পাওয়ার প্রক্রিয়াও চলছে বলে জানা যায়।
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, ইউপি নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় এবং বিদ্রোহী প্রার্থীর হয়ে কাজ করায় তৃণমূলে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়। গত ১৭ ডিসেম্বর গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির বৈঠকে ইউপি এবং জেলা ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযুক্ত নেতাদের ক্ষমা করে দেয়া হয়। কারণ তাদের বেশিরভাগই ইউনিয়ন, জেলা-উপজেলা কমিটির সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন দীর্ঘদিন ধরে। নির্বাচনের আগেই তুণমূলে দলকে শক্তিশালী এবং ঐক্যবদ্ধ করতে দলের নীতি নির্ধারকেরা ওই সিদ্ধান্ত নেন। সেটা করা না হলে নির্বাচনের সময় দলের ঐক্য ধরে রাখা কঠিন হবে বলে মনে করেন দলের নীতি নির্ধারকেরা।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এস কামাল হোসেন বলেন, "আগামী নির্বাচনে দলকে শক্তিশালী এবং সুশৃঙ্খল করার জন্যই বিদ্রোহীদের দলে ফিরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর যেহেতু বিএনপি-জামাত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেয়নি তাই আওয়ামী লীগ থেকে বিদ্রোহী প্রার্থীরা নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করছেন। তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়নি, অব্যাহতি দেয়া হয়েছিলো। এখন ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে।”
সাধারণ ক্ষমার বাইরে এখন ক্ষমার আবেদনের ভিত্তিতেও বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের ক্ষমা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেই প্রক্রিয়ায় গাজীপুরের জাহাঙ্গীর আলমের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে।
জানা গেছে ক্ষমা পাওয়ার পাইপলাইনে আরো আছেন ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর ক্যাসিনো কাণ্ডসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে গ্রেপ্তার ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাবেক সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট। তিনি এখন জামিনে আছেন। একই ঘটনায় গ্রেপ্তার সাবেক যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়াও জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তিনিও ক্ষমার লাইনে আছেন। যুবলীগের বহিষ্কৃত চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকেও দলে ফেরানো হতে পারে। এছাড়া স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি মোল্লা মোহাম্মদ আবু কায়সারকেও আবার রাজনীতিতে সক্রিয় করার কথা হচ্ছে। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথের বহিষ্কারাদেশও প্রত্যাহার হতে পারে।
এস এম কামাল হোসেন বলেন, "ক্ষমা চাইলে তো ক্ষমা করা যায়। তারা তো দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নন। ফাঁসির আসামিও তো মাফ পায়।”
উকিল সাত্তার কৌশল:
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের বিএনপির সংসদ সদস্য উকিল আবদুস সাত্তার সংসদ থেকে দলের সিদ্ধান্তে পদত্যাগের পর দল থেকে পদত্যাগ করে স্বতন্ত্র হিসেবে উপ-নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। বিএনপি এরপর তাকে আবার বহিষ্কার করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রার্থী না দিয়ে তাকেই সমর্থন দিয়েছে। তারা জয়বাংলা মিছিল দিয়ে সাত্তারের নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি যদি না যায় তাহলে যেসব কৌশল আওয়ামী লীগ করবে তার মধ্যে একটি হতে পারে "সাত্তার কৌশল”। বিএনপির নেতাদের দল থেকে পদত্যাগ করিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থী না দিয়ে তাদের পাস করার সুযোগ করে দেবে। একইভাবে দলে ভাঙন ধরানোর জন্যও এই কৌশল কাজে আসতে পারে বলে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা মনে করেন। তাদের একজনের কথা "বিএনপিতে অনেক সাত্তার আছে সময় মতো দেখতে পাবেন।” এস এম কামাল হোসেন বলেন, "যারা মানুষের সেবা করতে চান তারা দল নির্বাচনে না গেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন।”