বিপদেও হাল ছাড়েননি নারী মুক্তিযোদ্ধা মাজেদা
২৫ এপ্রিল ২০১২বঙ্গবন্ধুর স্নেহের পরশ নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাঁকে সাহস যুগিয়েছে৷
শরীয়তপুরের নড়িয়ায় ১৯৪৭ সালে জন্ম মাজেদা শওকত আলীর৷ পিতা আব্দুল ওয়াহেদ এবং মা সালমা ওয়াহেদ৷ পাকিস্তান সেনা বাহিনীর তৎকালীন ক্যাপ্টেন শওকত আলীর সাথে বিবাহের পর থেকেই স্বাধিকার আন্দোলনের ব্যাপারে সোচ্চার হন মাজেদা৷ দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য চলমান প্রক্রিয়ার সাথে জড়িয়ে পড়েন তিনি৷ কারণ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ যে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা হয় তাঁদেরই একজন কর্নেল (অবঃ) শওকত আলী৷ তাই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে সেই ছেষট্টি সাল থেকেই আন্দোলন, সংগ্রাম, জেল, নির্যাতন - এসব কিছুর মধ্য দিয়ে দিন পার করতে হয়েছে সংগ্রামী দম্পতি মাজেদা ও শওকত আলীকে৷
ডয়চে ভেলের সাথে টেলিফোন আলাপচারিতায় এসময়ের লোমহর্ষক ঘটনার কথা জানালেন নারী মুক্তিযোদ্ধা মাজেদা শওকত আলী৷ তিনি বলেন, ‘‘আমার স্বামী তৎকালীন ক্যাপ্টেন শওকত আলী তখন কুমিল্লা সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন৷ তখন আমাদের প্রথম সন্তানের বয়স ছিল মাত্র দশ মাস৷ সেসময় তিনি আমাকে একদিন বললেন যে, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে৷ আর এতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ মুজিব ভাই৷ তখন থেকেই আমি জানতাম যে, তারা একটা পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য৷ তখন আমাদের বিবাহিত জীবনের মাত্র এক-দেড় বছর পেরিয়েছে৷ তখন তিনি বলছিলেন যে, এই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেলে, ধরা পড়ে গেলে আমার শাস্তি হতে পারে৷ শাস্তিতে আমার মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে৷ এমন কঠিন কথা শুনে আমি খুব বিব্রত এবং দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়েছিলাম৷ তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন, দেশকে ভালোবাসতে হলে জীবন দিতে হয়৷ তোমার মতো অনেক মেয়ে বিধবা হয়ে যাবে৷ তোমার বাবুর মতো অনেক বাবু তাদের বাবাকে হারাবে৷ কিন্তু তারপরেও দেশের জন্য যুদ্ধ করতে হবে৷ দেশকে ভালোবাসতে হবে এবং আমাদের বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে৷ সেই থেকেই আমি জানতাম যে, যে কোন উপায়েই হোক বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হবে৷ এটা ১৯৬৬ সালের কথা৷''
কুমিল্লা থেকে পরে করাচিতে বদলি করা হয় সেনা কর্মকর্তা শওকত আলীকে৷ তাঁর সাথে স্ত্রী মাজেদা এবং শিশুপুত্র করাচি চলে যান৷ কিন্তু ১৯৬৮ সালের ১০ই জানুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার হন শওকত আলী৷ এসময়ের করুণ অবস্থার কথা তুলে ধরলেন সাহসী ও ত্যাগী নারী মাজেদা শওকত আলী৷ তাঁর ভাষায়, তাঁকে বন্দি করে করাচি থেকে রাওয়ালপিন্ডি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল৷ এরপর তাঁর আর কোন খবর পায়নি৷ আমি জানতাম না যে, তিনি কোথায় কিংবা কী অবস্থায় আছেন৷ তিনি বেঁচে আছেন কিনা তাও জানতাম না৷ সেখানে ১৯৬৭ সালের ৬ই জুন আমাদের দ্বিতীয় সন্তান পৃথিবীতে আসে৷ এসময় দু'টি সন্তান নিয়ে গৃহবন্দি অবস্থার মতো সেখানে ছিলাম এক মাস৷ বাংলাদেশে আসার মতো কোন ব্যবস্থা ছিল না৷ আমার কাছে ভাড়ার টাকাও ছিল না৷ আমার সাথে বাঙালি বা অবাঙালি কেউ যোগাযোগ করতো না৷ তবে আমার স্বামী বন্দি হওয়ার প্রায় ২৫ দিন পর এক বাঙালি তরুণ সেনা কর্মকর্তা খুব ঝুঁকি নিয়ে আমাদের বাসায় আসে৷ আমার সামান্য কিছু জিনিস ছিল৷ সেগুলো বিক্রি করে তিনি আমাদের বাংলাদেশে আসার ব্যবস্থা করে দেন৷''
ইতিমধ্যে প্রায় ছয় মাস পেরিয়ে যায় কিন্তু মাজেদা তাঁর স্বামীর কোন খোঁজ পাননি৷ ছয় মাস পরে ঢাকা সেনানিবাসে বিশেষ আদালতে বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জনের বিচার শুরু হয়৷ এরপর ১৯৬৯ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি গণ আন্দোলনের মুখে বঙ্গবন্ধুসহ ৩৪ জন ছাড়া পেয়েছিলেন৷ শুধুমাত্র সার্জেন্ট জহুরুল হককে সেনানিবাসে বিচারাধীন অবস্থায় জেল-হাজতের ভেতরে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল বলে জানান মাজেদা৷ তিনি আরো জানান, ‘‘১৯৬৮ সালের ১৯শে জুন যেদিন বিশেষ আদালতে বিচার শুরু হয়৷ সেদিন বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল আদালত প্রাঙ্গণে৷ সেদিন আদালত প্রাঙ্গণ ছিল লোকে লোকারণ্য৷ সবার খুব মন খারাপ ছিল৷ কারণ প্রায় ছয় মাস ধরে আমরা কারো পিতা, কারো স্বামী, কারো ছেলে যারা আটক ছিল তাদের কোন খবর জানতাম না৷ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন৷ আমি খুব কাঁদছিলাম৷ হঠাৎ করে আমার মাথায় কারো হাত আমি অনুভব করেছিলাম৷ তাকিয়ে দেখি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান৷ তিনি আমার মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দিলেন৷ বললেন, তোরা কাঁদবি না, ওদেরকে আমি ফিরিয়ে আনবো৷ এদেশের মানুষ আমাদের মুক্ত করে আনবে৷''
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন