বেতার ও টেলিভিশনের নিয়মিত শিল্পী মুক্তিযোদ্ধা আরতি ধর
১৭ আগস্ট ২০১১১৯৪৫ সালে সিলেটে জন্ম শিল্পী আরতি ধরের৷ পিতা বনবিহারী ধর৷ মাতা শুধারানী ধর৷ ছোট থেকেই গানের প্রতি প্রগাঢ় ঝোঁক ছিল তাঁর৷ তার সাথে ছিল বাবা-মার উৎসাহ এবং সহযোগিতা৷ তাই ভারতে গিয়ে বড়মাপের সংগীত গুরুর কাছে গান শেখার সুযোগ হয় তাঁর৷ পাশাপাশি লেখাপড়াও করেন ভারতে৷ কলেজ জীবন শেষ করে দেশে ফিরে সংগ্রামী চেতনার গান পরিবেশন করে লাখো বাঙালির মনে স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রেরণা জাগিয়ে তোলেন৷ ১৯৬২ সাল থেকেই বেতারের নিয়মিত শিল্পী হিসেবে গান গাওয়া শুরু করেন৷ এরপর ঢাকা থেকে টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু হলে ১৯৬৬ সাল থেকে টেলিভিশনে গান গাইতেন আরতি৷ গণমুক্তি শিল্পী গোষ্ঠীর সাথেও সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন স্থানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করতেন তিনি৷
ফলে ২৫ মার্চ পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে আরতি ধরও ছিলেন পাক সেনা ও তাদের দোসরদের কড়া নজরে৷ বেশ কয়েকবার তাঁর বাড়ির সামনেই পাক সেনাদের গাড়ি এসে থেমেছে৷ পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা এসে আরতির বাড়িতে তাঁর খোঁজ করেছে৷ তবে শেষ পর্যন্ত তাদের চোখে ধুলো দিয়ে কৌশলে রক্ষা পান আরতি৷ সান্ধ্য আইন শিথিল হলে বৃদ্ধ বাবার সাথে মণিপুরি পাড়ায় গিয়ে কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকেন তিনি৷ পরে করিমগঞ্জ দিয়ে ভারতে পাড়ি জমায় আরতি ধরের পরিবার৷
পথে পাক সেনাদের নাগালের মধ্যে পড়ে গেলেও কীভাবে রক্ষা পান সেকথা জানালেন ডয়চে ভেলের কাছে৷ আরতি বলেন, ‘‘পথের মধ্যে একদিন সন্ধ্যা হয়ে গেছে৷ বাবা সাথে ছিলেন৷ একটা ভাঙা সেতুর নিচ দিয়ে পার হতে হবে৷ হঠাৎ শুনতে পেলাম পাক সেনারা এদিকে আসছে৷ সেখানে আমরা প্রায় আটকা পড়ে গিয়েছিলাম৷ তারপর কোন রকমে তাদের চোখে ফাঁকি দিয়ে পাশের একটা বাড়িতে আমরা বেশ কয়েকজন লুকিয়ে থাকলাম৷ সেখান থেকেই দেখতে পেলাম, পাক সেনারা সেখান দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল৷''
ভারত গিয়ে আবার মিলিত হন তাঁর আগের শিল্পী গোষ্ঠীর সদস্যদের সাথে৷ তাঁরা একসাথে আবার শিল্পী গোষ্ঠীর কাজ শুরু করেন৷ মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেন চার নম্বর সেক্টরে ফরিদ গাজির নেতৃত্বে৷ বিভিন্ন এলাকায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন আরতি এবং তাঁর সহকর্মীরা৷ সেসব অর্থ মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে পৌঁছে দিতেন যুদ্ধের প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য৷ সেসময়ের উদ্দীপনামূলক গানগুলো সম্পর্কে আরতি বলেন, ‘‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গানগুলো গাইতাম আমরা৷ তখন তো সবার মুখে মুখে ছিল গানগুলো৷ যেমন স্বাধীন স্বাধীন দিকে দিকে, জয় বাংলা বাংলার জয়, শোন এক মুজিবুরের কণ্ঠ থেকে লক্ষ মুজিবুরের কণ্ঠে, নোঙর তোল তোল, সময় যে হলো হলো - এই গানগুলিই করতাম বেশি৷'' সীমান্ত এলাকায় গান পরিবেশন করতে গিয়ে একদিন বেশ রাত হয়ে যায়৷ হঠাৎ দলছুট হয়ে পড়েন আরতি৷ শেষ পর্যন্ত সেই রাতে আর শিবিরে ফিরতে পারেননি৷ বরং এক বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে রাত কাটাতে হয়েছে আরতি এবং তাঁর বাবাকে৷
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবারও বেতার এবং টেলিভিশনে নিয়মিত শিল্পী হিসেবে গান পরিবেশন করেন৷ বিশেষ করে সিলেটের আঞ্চলিক গান, বাবা শাহজালালকে নিয়ে ভক্তিমূলক গান এবং হাসন রাজার গানে তাঁর রয়েছে বিশেষ খ্যাতি৷ লন্ডন, কাতার, আবুধাবি, দুবাই, বাহরাইনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হাসন রাজার গান গাইতে গিয়েছেন তিনি৷ ২০১০ সালের ডিসেম্বরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ২৮ জন শিল্পী ও শব্দসৈনিককে সম্মাননা জানানো হয়৷ সেখানে তথ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদের কাছ থেকে সম্মাননা পদক গ্রহণ করেন আরতি ধর৷
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ