ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাচার সরকার চাইলে প্রতিরোধ করা যেতো
১ নভেম্বর ২০২২কারণ এই এই অর্থ আমদানি রপ্তানির আড়ালে ব্যাংকিং চ্যানেলেই পাচার হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) সোমবার জানিয়েছে গত অর্থ বছরে(২০২১-২২) শতকরা ২০ থেকে ২০০ ভাগ অতিরিক্ত আমদানি মূল্য দেখিয়ে অর্থ পাচারের ঘটনা তারা শনাক্ত করেছেন। এই ধরনের সন্দেহজনক লেনদেনের সংখ্যা গত অর্থ বছরে আট হাজার ৫৭১টি। এই লেনদেনের সংখ্যা তার আগের অর্থ বছরের চেয়ে ৬২.৩৩ শতাংশ বেশি। তখন এমন লেনদেন হয়েছে পাঁচ হাজার ২০৮টি।
বিএফআইইউয়ের প্রধান কর্মকর্তা মো. মাসুদ বিশ্বাস জানিয়েছেন,তারা আইনি ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগসহ (সিআইডি) বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন।
২০১৯-২০২০ অর্থবছরে এমন সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছিল তিন হাজার ৬৭৫টি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তিন হাজার ৫৭৩টি। এতে স্পষ্ট যে ব্যাংকিং চ্যানেলে অব্যাহতভাবে অর্থ পাচার বাড়ছে। আর গত অর্থ বছরের অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, "বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর এবং কাস্টমস চাইলে এই অর্থ পাচার ঠেকাতে পারত।” আর ব্যাংকার মো. নুরুল আমিন বলেন," আমরা অর্থপাচার বন্ধ করতে চাই না। তাই বন্ধ হয় না।”
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, গত অর্থ বছরে আমদানি মূল্য শতকরা ২০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত পণ্যমূল্য অতিরিক্ত দেখিয়ে (ওভার ইনভয়েসিং) অর্থ পাচার করা হয়েছে। তবে বিশ্লেষকেরা বলেন, কম রপ্তানি মূল্য (আন্ডার ইনভয়েসিং) দেখিয়েও অর্থ পাচার করা হয়। শুধু তাই নয়, যত পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলা হয় তার চেয়ে কম পণ্য আমদানি করেও অর্থ পাচার করা হয়।
গত অর্থ বছরে মোট কত অর্থ এবং কোন দেশে ও কারা পাচার করেছে তা জানায়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। ২৬ অক্টোবর বিএফআইইউ উচ্চ আদালতকে জানায়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে ১০টি দেশের সঙ্গে চুক্তি করতে চায় তারা। এজন্য তিন মাস সময় বেঁধে দিয়েছে আদালত। বিদেশে পাচার করা অর্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য, সাক্ষ্য প্রমাণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তা গ্রহণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড, হংকং ও চীনের সঙ্গে এই চুক্তি করতে যাচ্ছে বিএফআইইউ। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকই বলছে পাচার করা অর্থ ফেরত আনা কঠিন। শতকরা দুই ভাগের মত ফেরত আনা যায়।
যমুনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল আমিন বলেন,"ফেরত আনা অনেক জটিল হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক যে অর্থ পাচারের কথা বলছে তা প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিলো। কারণ এই অর্থ পাচার হয়েছে ব্যাংকিং চ্যানেলে। হুন্ডির মাধ্যমে নয়। হুন্ডিতে টাকা পাচার হলে তা ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে হয়।”
তার কথা,"পণ্যের মূল্য বেশি দেখিয়ে আমদানি করে অর্থ পাচার করা হয় তা আটকানো সম্ভব। কারণ যেসব পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলা হয় সেটা আন্তর্জাতিক বাজারে যাচাই করলেই দেখা যাবে পণ্যের দাম বেশি দেখানো হয়েছে কী না। একটি পণ্যের দাম যদি ২০০ ভাগ বেশি দেখানো হয় তাহলে তা ধরা পবেনা কেন? একইভাবে রপ্তানি পণ্যের দাম কম দেখালেও তা ধরা সম্ভব।”
তিনি বলেন,"এটা দেখার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের। তারা সেটা দেখছে না কেন? তাদের কি কোনো মেকানিজম নাই? এখন তো সারাবিশ্বেই কোথায় কখন কোন পণ্যের দাম কত তা কয়েক মিনিটের মধ্যেই জানা সম্ভব।”
"আসলে আমরা অর্থ পাচার বন্ধ করতে চাই না বলেই পাচার বন্ধ হয় না,” মন্তব্য এই ব্যাংকারের।
বাংলাদেশ ব্যাংক যে হিসাব দিয়েছে তাতে ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাচার বাড়ছে। এর একটি কারণ হতে পারে ডলারের সাথে নানা ধরনের বিনিময় হার। নুরুল আমিন বলেন,"এই পরিস্থিতিতে যেকোনো ব্যবসায়ী অর্থ পাচারের কৌশল বের করতে পারবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি রপ্তানির আড়ালে গত অর্থ বছরে পাচার হওয়া অর্থের হিসাব না দিলেও ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) বলছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে চার হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় সোয়া চার লাখ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, "ব্যাংকিং চ্যানেলে এই অর্থ পাচার যে বন্ধ করা যায় তা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন কেন বলছে? তারা তো এই টাকা পাচার বন্ধে আগেই উদ্যোগ নিতে পারত।”
তিনি বলেন,"বাংলাদেশ ব্যাংক এনবিআর ও কাস্টমস এরা চাইলেই ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাচার বন্ধ হয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক বাজারে কোন পণ্যের দাম কত এটা জানতে তো এখন আর গবেষণা করার দরকার নেই। এটা এখন ওপেন। সবাই জানতে পারে। তাহলে আমদানি পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে বা রপ্তানি পণ্যের দাম কম দেখিয়ে কীভাবে অর্থ পাচার করে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরে তো এর ডকুমেন্ট থাকে।”
তিনি জানান," পণ্য আমদানির নামে এলসি খোলে কিন্তু সেই পণ্য আসেনা। খালি কন্টেইনার আসে। দেশের টাকা বাইরে চলে যায়। এগুলো কাস্টমস দেখে না?”
তার কথা,"এর সঙ্গে দেশি-বিদেশি চক্র জড়িত। দেশের বাইরে যেখানে রপ্তানি করা হয় তারা পাচারে সহায়তা করে। আবার যাদের কাছ থেকে আমদানি করা হয় তারাও সহায়তা করে।”
পণ্যের দাম বেড়েছে। কিন্তু কত বেড়েছে। সেটা যাচাই করে দেখলেই ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাচার বন্ধ হবে বলে জানান তিনি।
তার অভিমত,"বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব তথ্য দিচ্ছে তা আসলে কোনো কাজের নয়। তারা কী ব্যবস্থা নিয়েছে সেটা এখন তাদের জানানো উচিত। কারণ এটা তাদের দায়িত্ব।”