ভারতের সংরক্ষণ ব্য়বস্থা নিয়ে আলোচনা করতে হলে প্রথমেই জেনে নেওয়া দরকার, ১৪০ কোটির দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং চাকরিতে কত শতাংশ কোটা আছে। ভারতীয় সংবিধান পিছিয়ে পড়া শিডিউলড কাস্ট, অর্থাৎ তফশিলি জাতির জন্য় ১৫ শতাংশ, শিডিউলড ট্রাইব, অর্থাৎ তফশিলি উপজাতির জন্য় সাত দশমিক পাঁচ শতাংশ, আদার ব্য়াকওয়ার্ড ক্লাস (ওবিসি) অর্থাৎ, অন্যান্য় পিছিয়ে পড়া অংশের জন্য ২৭ শতাংশ এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা গোষ্ঠীর জন্য় ১০ শতাংশ সংরক্ষণের ব্য়বস্থা করেছে। সব মিলিয়ে মোট আসনের ৫৯ দশমিক পাঁচ শতাংশ সংরক্ষণের আওতাভুক্ত।
সংরক্ষণের এই পদ্ধতি নিয়ে ভারতে বিতর্ক নতুন নয়। উল্লেখ্য, সংবিধানের প্রণেতা ভীমরাও আম্বেডকরের যুক্তি ছিল, সামাজিক বিভেদের জন্য় দীর্ঘদিন ধরে ভারতে যে জনগোষ্ঠীগুলি পিছিয়ে পড়েছে, তাদের উত্তরণের জন্য়ই সংরক্ষণ ব্য়বস্থার প্রয়োজন। এবং সে কারণেই সংবিধানে সংরক্ষণের উল্লেখ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, একটি নির্দিষ্ট সময় পর যখন পিছিয়ে পড়া শ্রেণিগুলি শিক্ষা এবং অর্থনৈতিকভাবে মূলস্রোতের অংশ হয়ে উঠবে, তখন ধীরে ধীরে এই সংরক্ষণ তুলে দেওয়া হবে।
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, সংরক্ষণ উঠে তো যায়ইনি, বরং আরো বেড়েছে। ২৭ শতাংশ ওবিসি সংরক্ষণ পরবর্তীকালের ঘটনা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কমিশনকে নিযুক্ত করা হয়েছে ভারতের সামাজিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য। এর মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা যেমন আছেন, তেমনই পিছিয়ে পড়া জাতি, উপজাতিরাও আছেন। মন্ডল কমিশন, সাচার কমিশন, রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশন এর মধ্যে অন্য়তম। বস্তুত, রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশন শুধুমাত্র ধর্মীয় সংখ্যালঘু নয়, ভাষাগতভাবে সামাজিক বিন্য়াস নিয়েও কাজ করেছিল।
স্বাধীনতার এত বছর পরে অধিকাংশ কমিশনের রিপোর্টে দেখা গেছে, পিছিয়ে পড়া শ্রেণির উন্নয়ন যতটা হওয়ার কথা ছিল, ততটা হয়নি। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে এই সংরক্ষণের জন্য়ই পিছিয়ে পড়া শ্রেণির একটি অংশ মূলস্রোতে মিশে যেতে পেরেছে। অর্থাৎ, সংরক্ষণব্য়বস্থার সুফল মিলেছে।
সংরক্ষণ বিতর্ক একরৈখিক নয়। এর মধ্যে বিভিন্ন স্তর আছে। ফলে এক কথায় সংরক্ষণ উঠে যাওয়া উচিত অথবা সংরক্ষণ থাকা দরকার- এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কঠিন। ভারতের মতো বৈচিত্রের দেশে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার দিকে যেমন অসংখ্য যুক্তি আছে, সংরক্ষণ তুলে দেওয়ার যুক্তিও তেমন কম নয়। তেমনই কিছু প্রচলিত যুক্তি নিয়ে আলোচনা করা যাক।
সার্বিকভাবে যদি ভারতীয় রাজনীতির দিকে তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাবে, এত বছর ধরে রাজনীতির একটি বড় ধারা জাত-পাত, ধর্মকে আশ্রয় করে বেড়ে উঠেছে। বিশেষ করে উত্তর ভারত এবং দক্ষিণের একটি বড় অংশে রাজনীতি পরিচালিত হয় এই অঙ্কগুলি মাথায় রেখে। সংরক্ষণ ব্য়বস্থা সেখানে সামাজিক কল্যাণ নয়, রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্য়বহৃত হয়েছে দিনের পর দিন। হয়েছে বলেই, তথাকথিত পিছিয়ে পড়া শ্রেণিগুলিকে মূলস্রোতের অংশ হতে দেওয়া হয়নি। বরং জাতিগত, ধর্মীয় বিভেদ টিকিয়ে রাখা হয়েছে। আজও উত্তর ভারতের নির্বাচনে জাতের ভিত্তিতে ভোট বিভাজন হয়। রাজনৈতিক সভায় সরাসরি জাত, ধর্ম নিয়ে প্রচার করা হয়। ফলে এই অঞ্চলে তফশিলি সংরক্ষণ একটি রাজনৈতিক বিষয় হয়ে উঠেছে। কোন জাত কোথায় কত শতাংশ সংরক্ষণ পাবে, তা নিয়ে এখনো এই অঞ্চলে আন্দোলন হয়, রাজনৈতিক দর কষাকষি হয়। যারা এই আন্দোলনে অংশ নেন, তাদের সিংহভাগই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। সংরক্ষণ তাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার মাত্র। সংরক্ষণ যখন রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হয়, তখন তার সামাজিক প্রশ্নগুলি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। বলতে দ্বিধা নেই, ভারতে সে ঘটনা ঘটেছে।
পাশাপাশি আবার এ কথাও সত্য়, সংরক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষ। গোটা জনজাতি অধ্যুষিত বেল্টে সংরক্ষণব্য়বস্থা ব্যাপকভাবে কাজ করেছে। সংরক্ষণ হয়েছিল বলেই আজ পিছিয়ে পড়া শ্রেণি বা গোষ্ঠীর বহু মানুষ মূলস্রোতের অংশ হতে পেরেছেন। জনজাতি পরিচয়ের ভিত্তিতে আলাদা রাজ্য় তৈরি হয়েছে। বহু সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন, পিছিয়ে পড়া শ্রেণিকে পুরোপুরি মূলস্রোতে নিয়ে আসার জন্য় আরো বেশ কিছুদিন সংরক্ষণ ব্য়বস্থা চালু থাকা দরকার। তাদের যুক্তি, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর সাকুল্য়ে দুইটি প্রজন্ম সংরক্ষণের সুবিধা পেয়েছে। আরো কয়েকটি প্রজন্ম এই সুযোগ পেলে সার্বিকভাবে একটি শ্রেণির উন্নতি হবে। ৭৫ বছর সামাজিক উন্নতির নিরিখে খুব বেশি সময় নয়। সমাজবিজ্ঞানীদের অনেকেই মনে করেন, গত কয়েকদশকে সামাজিক বিন্য়াসের বেশ কিছু সমীকরণ বদলেছে। ফলে সংরক্ষণের পদ্ধতিগত কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন। জাতি উপজাতি, ধর্মীয় শ্রেণির পাশাপাশি ভাষাগতভাবে পিছিয়ে থাকা অংশ, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অংশকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। সে কাজ যে একেবারে হয়নি, তা নয়। হয়েছে বলেই ওবিসি সংরক্ষণের আওতায় তফশিলভুক্ত নয়, এমন অনেক গোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যে কারণে, সব মিলিয়ে ওবিসি সংরক্ষণের পরিমাণ ভারতে সবচেয়ে বেশি, ২৭ শতাংশ। আবার অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণিকেও চিহ্নিতকরণের কাজ শুরু হয়েছে। তাদের জন্য় আলাদা সংরক্ষণ শুরু হয়েছে।
এ কথা বলাই বাহুল্য় যে, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও ভারতে সব শ্রেণির মানুষ সমানাধিকারের জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি। বৈষম্য এখনো আছে। আর তা আছে বলেই সংরক্ষণের প্রয়োজন ফুরোয়নি। যতদিন সংরক্ষণ রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে থাকবে, ততদিন এই বৈষম্য মিটবে না। কারণ, ভারতীয় রাজনীতির চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে বিভেদ। রাজনীতি নয়, সংরক্ষণ নিয়ে এখনো পর্যন্ত যতগুলি সংস্কারমূলক কাজ হয়েছে, তা হয় করেছে আদালত, নইলে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন। আর সেই একেকটি আন্দোলন একেকটি কমিশন গঠন করতে বাধ্য করিয়েছে সরকারকে। যেখান থেকে সামাজিক পরিস্থিতির ছবিটি স্পষ্ট হয়েছে। আরো অনেক এমন কমিশনের প্রয়োজন আছে। এমন আরো অনেক সংস্কারের প্রয়োজন আছে। সংরক্ষণকে রাজনীতির হাত থেকে যতটা সম্ভব সরিয়ে নেওয়া এখন সবচেয়ে বড় চ্য়ালেঞ্জ।