ভারতে আত্মহত্যার সংখ্যা বেশি
১৫ জুন ২০১৬আত্মহত্যা সব দেশে সবকালেই ছিল, আছে এবং থাকবে৷ সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যান বলছে, বছরে গোটা দুনিয়ায় যত মানুষ আত্মহত্যা করে, তাদের মধ্যে অধিকাংশই ভারতীয়৷ সংখ্যার বিচারে বিশ্বে বছরে গড়ে আট লাখের মতো আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার ঘটে ভারতে৷ এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা দেখা যায় ভারতের দক্ষিণী রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গ ও মহারাষ্ট্রে৷
জাতীয় ক্রাইম ব্যুরো রেকর্ডের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে ভারতে গড়ে প্রতি ঘণ্টায় আত্মহত্যা করেছে ১৫ জন৷ অবাক করার মতো বিষয় হলো, এই আত্মঘাতীদের মধ্যে ৮০ শতাংশ মোটামুটি শিক্ষিত৷ আর গড়ে মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি, প্রায় দ্বিগুণ৷ তবে আঞ্চলিক ভিত্তিতে অনুপাতটা সমান নয়৷ মহিলাদের মধ্যে সবথেকে বেশি আত্মহত্যার ঘটে ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গে৷ উল্লেখ্য বছরে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার৷ এছাড়া মোট আত্মঘাতীদের বেশির ভাগের বয়স ১৫ থেকে ২৯ এবং ৩০ থেকে ৪৪ বছরের মধ্যে৷ জানা যায় আত্মহত্যা সাধারণত হয়ে থাকে বিষ খেয়ে, গলায় দড়ি দিয়ে অথবা গায়ে আগুন লাগিয়ে৷ দেখা গেছে, এ সমস্ত আত্মহত্যার প্রধান কারণ দুরারোগ্য অসুখ, দাম্পত্য তথা পারিবারিক বিবাদ এবং আর্থিক সমস্যা৷ তাছাড়াও আছে পরীক্ষায় ফেল, প্রেমে ব্যর্থতা বা বেকারত্ব৷
ভারতে আত্মহত্যা সবথেকে বেশি হয় কেন? আত্মহত্যা নিবারণের উপায়ই বা কী? এ সব প্রশ্নের উত্তরে এক নামকরা বেসরকারি হাসপাতালের মনোবিজ্ঞানী ড. অয়নাংশু নায়ক ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘ভারতে আত্মহত্যার যে পরিসংখ্যান দেওয়া হচ্ছে, সেই হিসেবের গোড়ায় গলদ৷ কারণ প্রথমেই মনে রাখতে হবে ভারতের বিপুল জনসংখ্যার কথা৷ জনসংখ্যার ভিত্তিতে ভারতে মাথা পিছু আত্মহত্যার সংখ্যা সর্বাধিক নয়৷ সেদিক থেকে দেখতে গেলে এশিয়া তথা বিশ্বে আত্মহত্যার ঘটনা সবথেকে বেশি জাপানে৷''
তিনি বলেন, ‘‘পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতাজনিত মানসিক চাপ ও হতাশার মোকাবিলা করার শক্তি মানুষ যখন হারিয়ে ফেলে তখনই আত্মহত্যার মতো অন্তিম পদক্ষেপ বেছে নেয় মানুষ৷ এটা কমাতে হলে মনোরোগ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়িয়ে তার প্রতিকারের কথা চিন্তা করতে হবে৷ এখনও ভারতের মতো দেশে মনোরোগ একটা লোকলজ্জার বিষয়৷ তাই তা গোপন রাখার প্রবণতা প্রবল৷ তাই সেটা বিপরীতমুখী করতে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে৷''
‘‘মনে রাখতে হবে, ক্যানসার, হৃদরোগ বা অন্য আর পাঁচটা রোগের মতো মানসিক হতাশা, বিষাদ ও জীবনবিমুখতা একটা বড় রোগ৷ দেহের অন্য অঙ্গের মতো মস্তিষ্কের রোগও হতে পারে৷ তাই তাকে লোকলজ্জা মনে করে চেপে রাখলে চলবে না৷ এখন তো মানসিক রোগের উন্নত ওষুধপত্র ও চিকিত্সা বেরিয়েছে৷ সেটাকে তুলে ধরতে হবে সামাজিক প্রচার অভিযানের মাধ্যমে৷ আমার মতে, অন্য রোগের চিকিত্সার মতো মানসিক রোগ চেপে না রেখে তার চিকিত্সা করা জরুরি৷''
মনস্তাত্ত্বিক অয়নাংশু নায়কের মতে, ‘‘কৃষকদের আত্মহত্যার পেছনেও রয়েছে কৃষি সংকটজনিত আর্থিক হতাশা৷'' আসলে ভারতে মানুষ সবথেকে বেশি আত্মহত্যা করে কীটনাশক খেয়ে৷ তাই এই মনোবিজ্ঞানীর মতে, ‘‘আত্মহত্যার পেছনে জীনঘটিত বা বংশগত কারণ না থাকলেও হতাশাবোধটা কিছুটা হলেও আছে৷''
তাঁর কথায়, ‘‘নিঃসঙ্গতাও আত্মহত্যার একটা বড় কারণ, বিশেষ করে বয়স্কদের ক্ষেত্রে৷ তাঁরা চিকিত্সকের কাছে আসেন না, চুপচাপ আত্মহত্যা করে বসেন৷ এর প্রতিকারের জন্য দরকার সামাজিক যোগাযোগ ও ‘সাপোর্ট'৷''
ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে ড. নায়ক তাঁর চিকিত্সাধীন এক রোগীর কথা উল্লেখ করেন, যিনি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন৷ বলেন, ‘‘কেন গিয়েছিলেন জানেন? নিজের ক্লাস টেনে পড়া ছেলে যাতে পরীক্ষায় সর্বাধিক নম্বর পায়, সেজন্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২২-২৩ ঘণ্টা পড়ার জন্য তিনি চাপ দিতেন ছেলেকে৷ তার ওপর বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মিশতেও দিতেন না৷ কিন্তু একাদশ শ্রেণিতে ছেলেটি ফেল করে৷ ছেলের ভবিষ্যত অন্ধকার ভেবে ভয়ংকর উদ্বেগে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন মা৷ এখনও তিনি আমার চিকিত্সাধীন৷''
মনোরোগ চিকিত্সক ড. নায়ক আরও যা বললেন, তার সারমর্ম হলো: এক, কৃষকদের আত্মহত্যা নিবারণে চাই সরকারি ও সামাজিক সমর্থন৷ এবং তাঁদের দেউলিয়া হওয়ার হাত থেকে বাঁচানো৷ দুই, কমবয়সি ছেলে-মেয়েদের মানসিক সমস্যা বা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের নিসঙ্গতার সমস্যা অনুধাবন করে তার প্রতিকারে মানসিক তথা সামাজিক সমর্থন দেওয়া৷ আর তিন, প্রাক-স্নাতক স্তরে মেডিক্যাল পঠন-পাঠনে ডাক্তার ও নার্সদের জন্য মানসিক চিকিত্সাকে পাঠ্যক্রমে আবশ্যক হিসেবে চিহ্নিত করা৷
বলা বাহুল্য, এ জন্য ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কাউন্সিলকে এগিয়ে আসতে হবে৷ তবে এটা করতে পারলে ভারতে মাথাপিছু মনোরোগ চিকিত্সকের অনুপাত বাড়বে, যা কিনা ভারতের জনসংখ্যার তুলনায় নেহাতই কম৷
ভারতে এত বেশি আত্মহত্যার কারণ কি বলে আপনার মনে হয়? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷