ভারতে করোনা কমছে কীভাবে
৪ আগস্ট ২০২১খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। গত ৮ মে ভারতে একদিনে চার লাখ একশর বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। গত ১৯ এপ্রিল দিল্লিতে একদিনে ২৮ হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হন। সেই সময় দিল্লি সহ ভারতের অবস্থা শোচনীয় জায়গায় পৌঁছেছিল। হাসপাতালে জায়গা নেই। অক্সিজেন নেই। ওষুধের দাম আকাশ ছোঁয়া। মৃতদের দেহ সৎকার করতে লম্বা লাইন। উত্তর প্রদেশ ও বিহারের গঙ্গায় মৃতদেহের মিছিল। গোটা ভারত জুড়ে ডেল্টা ও ডেল্টা প্লাস আতঙ্ক।
সেখান থেকে ৪ অগাস্টে আসা যাক। সারা ভারতে দিনে এখন গড়ে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন ৩০ থেকে ৪০ হাজার মানুষ। দিল্লিতে দিনে ৫০ থেকে ৬০ জন আক্রান্ত হচ্ছেন। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিয়ে দিল্লিতে প্রায় সব কিছুই খুলে গেছে। মেট্রো ও বাসেও যাত্রী নেয়ার ক্ষেত্রে আর কোনো সীমা নেই। ভারতে কেরালা, মহারাষ্ট্র, উত্তর পূর্বের রাজ্যগুলিতে এখনো করোনায় বহু মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গও পুরো স্বাভাবিক হয়নি। এই রাজ্যগুলোকে বাদ দিলে ভারতের অন্যত্র পরিস্থিতি আগের তুলনায় অনেকটাই ভালো।
অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে
কী করে সম্ভব হলো এইভাবে করোনার নিয়ন্ত্রণ? এমনিতে বিশ্বজুড়ে করোনার প্রবণতাই হলো, এর রেখচিত্র ক্রমশ উপরে উঠতে থাকে। একেবারে উপরে উঠে তা নীচে নামতে থাকে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু এই প্রবণতার কথা বলে ভারতের করোনা পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। যে দিল্লিতে দিনে ২৮ হাজার মানুষ একদিনে আক্রান্ত হয়েছিলেন, সেখানে সংখ্যাটা ৫০-৬০-এ নেমে আসার কারণ শুধু ভাইরাসের চরিত্র নয়।
দক্ষিণ দিল্লির একটি বেসরকারি হাসপাতালে করোনা ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা ফুসফুসের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পার্থপ্রতিম বোস ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''দিল্লিতে করোনা নিয়ন্ত্রণে আসার কয়েকটি কারণ আছে। প্রথমত, দিল্লিতে টিকা দেওয়ার হার যথেষ্ট ভালো। দ্বিতীয়ত, দিল্লিতে কড়া লকডাউন দীর্ঘদিন চলেছে। ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতির স্মৃতি মাথায় থাকার কারণে মানুষ মাস্ক পরছেন, দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছেন। সব চেয়ে বড় কথা, টিকার কারণে ও করোনা হয়ে যাওয়ার ফলে একটা বড় অংশের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে।''
পার্থপ্রতিম বোস মনে করেন, ''করোনার গ্রাফ একবার উপরে উঠবে, তারপর নীচে নামবে এটা ঠিক। এটা সব ভাইরাসের চরিত্র। কিন্তু সে কথা মাথায় রেখেই বলতে হচ্ছে, মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি না হলে, হার্ড ইমিউনিটি তৈরি না হলে করোনাকে ঠেকানো যাবে না। দিল্লি আজ যে অবস্থায় পৌঁছেছে, সেই অবস্থায় পৌঁছনো যাবে না।''
দিল্লিতে দীর্ঘদিন ধরে কড়া লকডাউন চালু ছিল। সেসময় কাছের দোকান-বাজার বা টিকা নিতে যাওয়া এবং খুব জরুরি পরিস্থিতি ছাড়া কেউ বাড়ির বাইরে পা রাখতে পারতেন না। রাখলে পুলিশের কাছে জবাবদিহি করতে হত।
তিন কারণের মিলিত ফল
কলকাতার চিকিৎসক সাত্যকি হালদার মনে করেন, ভারতে যে করোনার বাড়বাড়ন্ত কমেছে, তার পিছনে তিনটি কারণ আছে। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, ''ভারতে স্বাস্থ্য কর্মী, যারা করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন, তারা আগে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। তাদের দুই ডোজ টিকা দেয়ার পর অসুস্থ হওয়ার হার অনেকটাই কমেছে। দ্বিতীয়ত সাধারণ মানুষ কিছুটা সচেতন হয়েছেন। তারা স্বাস্থ্যবিধি মানছেন। তৃতীয় কারণ হলো, ভাইরাসের এপিডোমিয়োলজিকাল চরিত্র।'' তার ব্যাখ্যা, ''ভাইরাসের উত্থান যেমন থাকে, তেমনই পতন থাকে। ভাইরাস সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছে গেলে, তার সক্রিয়তা কমতে থাকে। তখন গ্রাফ নীচের দিকে নামে। এই সবকটি কারণ মিলেই ভারতের করোনার ভয়ংকর পরিস্থিতি অনেকটা ভালো হয়েছে।''
সাত্যকি হালদার একটা উদাহরণ দিয়েছেন। বানের সময় সুন্দরবনে বাঁধ ভেঙে জল চলে আসে গ্রামের ভিতর। আবার সেই জল নিজে থেকে পরে চলেও যায়। কিন্তু সরকার বা গ্রামবাসীরা বাঁধ তৈরি করে। তাতে জোয়ারের জল আটকায়। কিন্তু আবার ভয়াবহ বান এলে সেই বাঁধ ভেঙে যায়। তেমনই ভাইরাসের রেখচিত্র উপরে ওঠে এবং নীচে নামে এটা যেমন ঠিক, তেমনই এটাও ঠিক যে , করোনা প্রতিরোধে টিকা নিতে হবে, মাস্ক পরতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। তাহলেই করোনার জোয়ার আটকানো যাবে।
দিল্লির সাফল্যের পিছনে
দ্য প্রিন্টের হেলথ এডিটর অবন্তিকা ঘোষ ভারতে করোনা নিয়ে একটি বই লিখেছেন। প্রথম ঢেউয়ের সময় ভারতের পরিস্থিতি, কারণ, প্রাসঙ্গিক সব ব্যাখ্যা আছে সেই বইতে। অবন্তিকা ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে দিল্লিতে সেরোপজিটিভিটির (অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়া) হার ৮৬ শতাংশ। তার উপর দিল্লিতে ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সি মানুষদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি মানুষ টিকার অন্তত একটি ডোজ নিয়েছেন। ফলে তাদের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে।''
অবন্তিকার মতে, ''বিশ্বের অন্য জায়গায় এখন ডেল্টা, ডেল্টা প্লাসের কারণে করোনা বাড়ছে। কিন্তু দিল্লি তথা ভারতে ডেল্টা ও ডেস্টা প্লাসের তাণ্ডব সহ্য করে নিয়েছে। এখন ভাইরাস আবার কবে মিউটেট করবে, অ্যান্টিবডি কতদিন থাকবে, তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। তবে ভাইরাসের নতুন ও ভয়ংকর সংস্করণ যতদিন না আসছে, ততদিন আমরা কিছুটা ভালো সময় কাটাতেই পারি।''
বিশেষজ্ঞদের মতে, এর মধ্যে টিকাকরণ যতটা সম্ভব বাড়াতে হবে।
চিন্তার কারণ
এরপরেও চিন্তা আছে। বেশ ভালোরকমই আছে। সরকার ও বিশেষজ্ঞরা আর ফ্যাক্টর নিয়ে রীতিমতো চিন্তিত। আর ফ্যাক্টর মানে রিপ্রোডাকশন নম্বর বা আরটি। এর অর্থ হলো একজনের শরীর থেকে কতজনের মধ্যে করোনা ছড়াচ্ছে। ভারতে গড়ে আর ফ্যাক্টর হলো এক দশমিক দুই। তার কারণ, মহারাষ্ট্র, কেরালা সহ আটটি রাজ্যে আর ফ্যাক্টর বেশ বেশি। এখন তো যত মানুষের করোনা হচ্ছে, তার ৪৯ শতাংশই কেরালার।
কেন্দ্রীয় সরকারেরের করোনা টাস্ক ফোর্সের প্রধান ভি কে পল বলেছেন, ''আর ফ্যাক্টর শূন্য দশমিক ছয়ে নামিয়ে আনতে পারলে বলা যাবে করোনাকে বেশ খানিকটা নিয়ন্ত্রণে আনা গেছে। কিন্তু দেশের ৪৪টি জেলায় এই হার ১০ শতাংশের বেশি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব লব আগরওয়াল বলেছেন, "স্বাস্থ্যবিধি পালনের ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র শিথিলতা চলবে না। অতিমারির দপট এখনো আছে।"
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি মানতেই হবে, মাস্ক পরতে হবে, দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, দুই ডোজ টিকা নিতে হবে। করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাময়িক সাফল্য এসেছে মানে পরিস্থিতি যে আবার খারাপ হবে না, তার কোনো মানে নেই। বিশেষ করে এইমসের ডিরেক্টর গুলেরিয়া সহ অনেকের মতে, এরপর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে তৃতীয় ঢেউ আসতে পারে। তবে তা দ্বিতীয় ঢেউয়ের মতো অত ভয়ংকর নাও হতে পারে। তখন দিনে সর্বোচ্চ এক থেকে দেড় লাখ মানুষ আক্রান্ত হবেন। সেই সংখ্যাটাও তো কম নয়। তাই তারা বারবার সেই প্রবাদটার কথাই শোনাচ্ছেন, সাবধানতার মার নেই।