ভার্চুয়াল যোগাযোগের মাধ্যমে মাদকের হানা!
৪ জুন ২০২১ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী এলএসডি মাদকের মর্মান্তিক ‘শিকার' হওয়ার পর আবার মাদক নিয়ে হইচই চলছে বাংলাদেশে। একের পর এক এলএসডি মাদক গ্রহণকারী আটক হচ্ছে। কিন্তু এর সরবরাহকারী কারা তা চিহ্নিত করা বা তাদের ধরা সম্ভব হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, এই মাদক ভার্চুয়াল যোগাযোগের মাধ্যমে দেশের বাইরে থেকে সংগ্রহ করা হয়। কুরিয়ার বা অন্য কোনো মাধ্যমেও আসে। ঢাকায় এলএসডি মাদকের কয়েকটি চক্রকে আটক করেছেন গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)-র উপ-পুলিশ কমিশনার এইচ এম আজিমুল হক। তিনি এলএসডিবিরোধী এই অভিযান চালাতে গিয়ে দেখেন মাদক চোরাকারবারী ও ব্যবহারকারীরা নতুন নতুন প্রযুক্তি ও যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করছে। আর যারা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছেন, তারাও নানা মাধ্যমে নতুন নতুন মাদকের খবর পাচ্ছেন। কৌতুহলী হয়ে তা গ্রহণ করছেন। তিনি বলেন ,"তারা যেহেতু নতুন কৌশল ও প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন, আমাদেরও তাদের ধরতে ও চিহ্নিত করতে নতুন পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হচ্ছে।” তাই ‘প্রচলিত' ধারার মাদকের ব্যবহার কমলেও নতুন আরেক ধরনের মাদক এসেছে, যা বুঝতে সময় লাগে বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
বাংলাদেশে সম্প্রতি এলএসডি নিয়ে সাড়া পড়লেও এক বছর আগেও এই মাদকসহ ধরা পড়ার রেকর্ড আছে। আর আইচ নামে আরেক ধরনের মাদকও এখন সেবন করা হচ্ছে। ফেনসিডিল ও ইয়াবার পর এখন এই দু ধরনের মাদকের কারণেও বাংলাদেশকে নতুন এক পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হচ্ছে। তবে ইয়াবার ব্যবহার কমেছে বলেও মনে করছেন না বিশ্লেকরা।
মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ২০২০ সালে তিন কোটি ৬৮ লাখ ৮১ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে। ২০১৯ সালে এর পরিমান ছিল তিন কোটি চার লাখ ৪৬ হাজার পিস। ২০১৯ সালের চেয়ে ২০২০ সালে করোনার বছরে বেশি ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে।
বাংলাদেশে ইয়াবা আসে মিয়ানমার থেকে। ২০১৮ সালে ব্যাপক মাদকবিরোধী, বিশেষ করে ইয়াবাবিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়। শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী তখন আত্মসমর্পন করলেও তারা এখন জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। ক্রস ফায়ারে অনেক ‘মাদকব্যবসায়ী' নিহত হন। ২০১৮ সালে ওই অভিযানের বছর অবশ্য বেশি ইয়াবা উদ্ধার করে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। পাঁচ কোটি ৩০ লাখ ৪৮ হাজার পিস উদ্ধার করা হয় সে বছর। তবে অধিদপ্তর ছাড়াও পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও কোস্ট গার্ড মাদকের বিরুদ্ধে কাজ করে। তারাও বিপুল পরিমান মাদক উদ্ধার করে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম জানান, ২০১৮ সালে তারা এক গবেষণায় দেখেছেন দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ৭০ লাখ। তার মতে, এখন সেটা ৭৫-৮০ লাখ হয়েছে। তিনি বলেন, "মাদকসেবী কমেনি, বরং বেড়েছে। এই করোনার সময়ে মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে মাদক গ্রহণের প্রবনতা বেড়েছে।” তিনি বলেন, মাদক তরুণ সমাজকেই বেশি গ্রাস করছে৷ তাদের মধ্যে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীই বেশি। তারা নানা সংস্পর্শে এবং হতাশায় মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। তাছাড়া এখানে মাদক পাওয়ার নানা রুট আছে।
তিনি বলেন, "এই করোনার সময় মাদকের সরবরাহ চেইনে পরিবর্তন এসেছে। অনলাইনেই মাদকের খোঁজ পাওয়া যায়। বিক্রেতারাও অনলাইনে তাদের সাপ্লাই চেইন গড়ে তুলেছে। মাদক ব্যবসা ও সরবরাহে এখন কুরিয়ার সার্ভিসও ব্যববহার করা হচ্ছে।
অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে মাদক ব্যবসায়ীদের কৌশল পরিবর্তনের কথা জানান পুলিশ কর্মকর্তা এইচ এম আজিমুল হক। তবে তিনি মনে করেন, মাদকের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অপারেশনে কাজ হচ্ছে বলেই মাদক ব্যবসায়ীরা মাদক পাচার ও বিক্রির কৌশল পরিবর্তন করছে। তার কথায়, "তাদের কৌশল পরিবর্তনের সাথে আমাদেরও তাদের ধরতে নতুন কৌশল আয়ত্ব করতে হয়।”
মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত তাদের উদ্ধারের তালিকায় ইয়াবা পর্যন্ত আছে। এলএসডি এবং আইচ নেই। তাদের তালিকা থেকে এটাও স্পষ্ট যে, বাংলাদেশে গাঁজা, হোরোইন, ফেনসিডিলের মতো প্রচলিত মাদকের ব্যবহারও অব্যাহত আছে। ২০২০ সালে ১০ লাখ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করেছে তারা। হোরোইন ২১০ কেজি এবং কোকেন উদ্ধার করেছে চার কেজি।
অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. রবিউল ইসলাম বলেন, "বাংলাদেশে যেসব মাদক বেশি ব্যবহৃত হয় তার অধিকাংশই আসে দেশের বাইরে থেকে। এখন যে নতুন মাদকের কথা শোনা যাচ্ছে তা-ও বিদেশ থেকে আসছে। এর উৎস বন্ধ না করে শুধু ভিতরে অভিযান চালিয়ে মাদক বন্ধ করা কঠিন।”
তিনি জানান," মাদক ব্যবসায়ীরা মূলত তরুণদেরই টার্গেট করে তাদের ব্যবসার জন্য। সেভাবেই তারা তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করে। আর এই তরুণদের একাংশই আবার মাদক ব্যবসায়ীতে পরিণত হয়।”
তিনি বলেন, বাংলাদেশে মাদক কমার কোনো লক্ষণ নেই। আর মাদকগ্রহণকারীদের ৯০ ভাগই তরুণ। তাদের বয়স ৩৫-এর মধ্যে। ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, হতাশা ছাড়াও কৌতুহল, বিনোদন থেকেও তরুণরা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে।”
এইচ এম আজিমুল হক মনে করেন, তরুণদের মাদকের কবল থেকে বাঁচাতে বা দূরে রাখতে পরিবারকে সবার আগে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সন্তানদের আচরন সম্পর্কে জানতে হবে, বুঝতে হবে। মনিটরিং করতে হবে। তাদের ভার্চুয়াল জীবন সম্পর্কেও অভিভাকদের সচেতন হতে হবে বলে মনে করেন তিনি।