‘ভালোবাসার স্বাধীনতা'
৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫তবে বিষয়টি যে যেভাবেই দেখুন না কেন এটা নিয়ে আলোচনা করতেই হবে, কারণ বিষয়টি শারীরিক, মনোজাগতিক এবং বাস্তব৷
গত শনিবার ঢাকার ব্রিটিশ কাউন্সিলে মোড়ক উন্মোচন হওয়া এক কমিক স্ট্রিপে এই ‘ভালোবাসার স্বাধীনতা'র কথা বলা হয়েছে৷ এই স্ট্রিপে ধী নামে একটি মেয়ের গল্প বলা হয়েছে যে নাকি আরেকটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে৷ ধী বাংলাদেশের মফস্বল শহরের মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ে৷ তবে তার ভালোবাসা, ভালোলাগা, জীবনবোধ আর দশজনের মতো নয়৷ সে সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে, তার ভালবাসা সমলিঙ্গের প্রতি৷ এই ধী হলো বাংলাদেশের প্রথম সমকামী কমিক চরিত্র৷
এই চরিত্রটি সামাজিক প্রচলিত মূল্যবোধের কারণে দ্বিধায়ও পড়ে, পড়ে সংশয়ে৷ ধী তখন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না যে সে কি করবে- তার পরিবারকে খুশি করার জন্যে কোনো পুরুষকে বিয়ে করবে, আত্মহত্যা করবে নাকি তার মন যা চাইছে সে সেটাই করবে৷
বয়েজ অব বাংলাদেশ (বব) নামের একটি সমকামী গ্রুপ এই কমিক স্ট্রিপটি তৈরি করছে৷ তারা বলছেন, ‘‘এই কার্টুন চরিত্রটির মধ্য দিয়ে সারা দেশে ‘ভালোবাসার স্বাধীনতার' বার্তা পৌঁছে যাবে৷'' তাদের কথা, ‘‘কে কাকে ভালোবাসবে এই সিদ্ধান্ত ও স্বাধীনতা তার নিজের৷''
গ্রুপটির সদস্যরা জানিয়েছেন, ‘‘বাংলাদেশে সমকামিতা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত৷ তাই সমকামী নারী ও পুরুষকে গোপনে জীবনযাপন করতে হয়৷ অনেকে সাধারণ একটি পরিবারের ভেতরে থেকেও দ্বৈত জীবনযাপন করেন৷''
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমন্ত্রণ পেয়ে ব্রিটিশ কাউন্সিল মিলনায়তনে অল্প কিছু লোক এই সমকামী কমিক স্ট্রিপটি দেখেছেন৷ কিছু দেশি এবং বিদেশি সংবাদমাধ্যম খবরটি পরিবেশন করেছে৷ তবে সব পরিবেশনায় যেন একটু চাপা ভাব লক্ষ্য করা গেছে৷ হয়তো বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অথবা সামাজিক প্রেক্ষাপটের কারণে এমনটি হয়েছে বলে আমার ধারণা৷ তবে এই চাপা স্বর হয়তো ধীরে ধীরে উচ্চকিত হবে৷ এবার কমিক চরিত্রের মাধ্যমে হলো৷ এরপর হয়তো সত্যিকার বাস্তব চরিত্রের মাধ্যমে হবে৷ কারণ বাংলাদেশে সমকামিতা একটি বাস্তবতা৷ সেটা আমি গ্রহণ করি বা না করি৷ তারা আছেন এটাই সত্য৷ আইনে নিষেধ থাকায় তারা গোপনে আছেন, কিন্তু আছেন৷
সমকামিতা বাংলাদেশে আইনসিদ্ধ না হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বেশকিছু দেশে সমকামিতা আইনসিদ্ধ৷ আর ভারতে এনিয়ে আছে বিতর্ক৷ ২০০৯ সালে ভারতের আদালত একে বৈধতা দিলেও ২০১৩ সালে তা আর টেকেনি৷ ২০০৯ সালে ভারতের আদালতের রায়ের বক্তব্যটি বেশ কৌতূহল উদ্দীপক৷ ২০০৯ সালের ২রা জুলাই দিল্লি হাইকোর্টের এক রায়ে বলা হয়, ‘‘প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সম্মতিক্রমে সমকামিতার আচরণ অপরাধের আওতায় পড়েনা৷ এই রায়ে আরো বলা হয়েছে যে ভারতীয় দন্ডবিধির ৩৭৭ ধারা ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকার রক্ষা নীতির পরিপন্থি৷'' কিন্তু ২০১৩ সালের ১১ই ডিসেম্বর সমকামিতাকে অবৈধ ঘোষণা করে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট৷
সমকামী শব্দটি দিয়ে লিঙ্গবৈচিত্র্য পুরোপুরি প্রকাশ করা যায়না৷ এর সঙ্গে আছে উভকামিতা৷ আছে রূপান্তরিত লিঙ্গ৷ আর সব মিলিয়ে বলা হয় সংখ্যালঘু লিঙ্গ৷ এখন মানবাধিকারের ছাতায় সংখ্যালঘু লিঙ্গও অন্তর্ভুক্ত৷ বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গের আইনি স্বীকৃতি পেয়েছেনে হিজরারা৷
সমকামিতার কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছে বিজ্ঞান৷ আর তাতে দেখা যায় সমকামিতা প্রধানত জিনগত ও হরমোনগত৷ এক কথায় বলা যায় বয়োলোজিক্যাল৷ আরো একটু বিস্তারিত গবেষণায় বলা হয়েছে সমকামিতা মনোজৈবিক৷
সমকামিতা কি যৌন ও মানসিক বিকৃতি? এ নিয়ে না বোধক উত্তরই এসেছে অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক গবেষণায়৷
বাংলাদেশের সমকামীদের জন্য প্রথম অনলাইন গ্রুপ ‘গে বাংলাদেশ'৷ বর্তমানে বয়েজ অফ বাংলাদেশ হলো দেশের বৃহত্তম সমকামী সংগঠন৷ এটি ২০০৯ থেকে তারা সক্রিয়৷ এখন প্রশ্ন সমকামিতা আর ভালোবাসার স্বাধীনতাকে কী এক করে দেখা যায়?
সে প্রশ্নের জবাব আমি না দিয়ে বাংলাদেশের নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন-এর ‘লিঙ্গসূত্র' থেকে লম্বা একটা উদ্ধৃতি দিচ্ছি৷ আশা করি বিরক্তিকর হবে না৷ তিনি লিখেছেন, ‘‘লিঙ্গ কিন্তু তত সহজ নয়, যত সহজ বলে একে ভাবা হয়৷ লিঙ্গ শুধু শারীরিক নয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মানসিক, মনস্তাত্বিকও৷ অধিকাংশ লোক ভাবে জগতের সব সুস্থ মানুষই বুঝি শরীরে পুরুষ, মনেও পুরুষ; অথবা শরীরে নারী, মনেও নারী৷ কিন্তু এর ব্যতিক্রমও আছে৷ ব্যতিক্রমটা বুঝতে হলে জেন্ডার বা মনোলিঙ্গ বুঝতে হবে৷ শরীরে যেমন লিঙ্গ থাকে, মনেও এক ধরনের লিঙ্গ থাকে, লিঙ্গবোধ থাকে৷ যাদের শারীরিক জৈবলিঙ্গের সঙ্গে মনোলিঙ্গের কোনও বিরোধ নেই, তাদের আজকাল ‘সিসজেন্ডার' বলা হয়৷ জগতের সবাই সিসজেন্ডার নয়, অনেকে ট্রান্সজেন্ডার, সিসজেন্ডারের ঠিক উল্টো৷ পুরুষের শরীর নিয়ে জন্মেছে, কিন্তু মনে করে না যে সে পুরুষ, মনে করে সে নারী; আবার ও দিকে নারীর শরীর নিয়ে জন্মেছে, কিন্তু মোটেও সে বিশ্বাস করে না যে সে নারী, তার দৃঢ় বিশ্বাস সে পুরুষ৷ এই ট্রান্সজেন্ডাররা বা রূপান্তরকামীরা নড়নচড়নহীন রক্ষণশীল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ‘পেন ইন দি অ্যাস'৷ এদের দুর্ভোগ প্রতি পদে পদে৷ প্রচলিত ধ্যানধারণার বাইরে গেলে সবাইকেই অবশ্য দুর্ভোগ পোহাতে হয়৷''
ঢাকায় ধী এর গল্প এবার অনেকটা অনুচ্চ স্বরের কমিক চরিত্র৷ হয়তো এই চরিত্র এরপর ভালোবাসার স্বাধীনতার কথা আরো উচ্চস্বরে বলতে চাইবে৷ তসলিমা নাসরিন যে দুর্ভোগের কথা বলেছেন তা কমিয়ে আনতে বা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে চাইবে৷ যদি এই বাস্তবতা বায়োলোজিক্যাল হয় তাহলে এর বিরুদ্ধে আমি কীইবা বলতে পারি! যদি মনোজাগতিক গঠন সেরকম হয় তাহলে এটাতো বাস্তবতা৷ আর এই বাস্তবতা আমরা কী বাস্তবতার নিরিখে বুঝতে পারব? আমাদের আইন কী বলবে? আমাদের সমাজ এবং সামাজিক কাঠামোই বা কীভাবে দেখবে৷