ভাষার আড়ালে লড়াইটা রাজনৈতিক
২ অক্টোবর ২০২০সনাতনী বাংলা ভাষার পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ৷ সে নিয়ে আলোচনা৷ বাংলা ভাষায় ‘মুসলমানি’ ভাষা, ‘বাংলাদেশী বাংলা’র যে অনুপ্রবেশ ঘটেছে, তা বর্জনই মূল উদ্দেশ্য৷ সম্প্রতি সোশাল মিডিয়ায় এই নিয়ে একটি পোস্ট দেখে কেউ কেউ যেমন ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেছেন, তেমন অনেকেই এই তৎপরতার উদ্দেশ্যের সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন৷ বাংলা ভাষায় এই সময় যাঁরা লেখালেখি করছেন, তাঁদের কেউ কেউ বিতর্কটা এড়িয়ে যাচ্ছেন এই প্রাথমিক যুক্তিতেই, যে এই অবান্তর প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলে সময় খরচ করা নিতান্তই অর্থহীন৷ ভাষার হিন্দু–মুসলমান হয় না৷ আবার কেউ কেউ এই ভাষা-বিতর্ক খুঁচিয়ে তোলার পিছনে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ‘অ্যাজেন্ডা’ দেখতে পেয়ে শঙ্কিত৷
বাংলার বিশিষ্ট ভাষাবিদ ডঃ পবিত্র সরকার যেমন সোজাসুজি বললেন, ‘‘ভাষাবিদরা এই ধরনের উদ্ভট তত্ত্ব মানে না৷ ভাষা নানা উৎস থেকে শব্দ নেয়৷ অনেক সময় রাজনৈতিক কারণে৷ অন্য ভাষার রাজা আসে৷ তারা তাদের ব্যবস্থা কায়েম করে৷ এবং সেই ভাষার থেকে, তা ফার্সি হোক, বা ধর্মের ক্ষেত্রে আরবি হোক, তার থেকে বাংলা ভাষায় প্রচুর শব্দ এসেছে৷ পর্তুগিজ উৎস থেকে এসেছে৷ ইংরেজি উৎস থেকে এসেছে৷ সংস্কৃত উৎস থেকে তো এসেইছে৷ এগুলোকে Loan Word বলে৷ শব্দ-ঋণ৷ এ এমন এক ঋণ, যা ফেরত দিতে হয় না৷ এবং তার ফলে ভাষা সমৃদ্ধ হয়৷ ঋণ নিয়ে ভাষা কখনই দুর্বল হয় না৷ দরিদ্র হয় না৷ কাজেই আমি মনে করি, এটা একেবারেই অবান্তর, অবাস্তব একটা প্রকল্প৷ যে সংস্কৃত, বা তৎসম বা তদ্ভব শব্দ ছাড়া বাংলায় রাখা যাবে না, বা ব্যবহার করা যাবে না৷’’
বাংলাদেশী বাংলা, বা তথাকথিত মুসলমানি বাংলা বর্জনের ডাক সম্বন্ধে পবিত্র সরকারের মন্তব্য, ‘‘এরা তো নির্বোধ!বাংলাদেশী বাংলা তো ওরা জানে না, বাংলাদেশের লেখা যদি ওরা পড়ে, তা হলে দেখবে সেখানে প্রচুর সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার হয়৷ মুসলমান জনগোষ্ঠীর ভাষায় কিছু আরবি–ফার্সি থাকবেই৷ চট্টগ্রামে হিন্দুরাও ‘পানি’ বলে, সেটা আসলে সংস্কৃত থেকেই এসেছে৷ কাজেই এই ধরনের কথাবার্তা উদ্ভট এবং আমি বলব, বাতুলের কথাবার্তা৷ আমরা এই কথাবার্তাকে অসঙ্গত, অনুচিত এবং বিদ্বেষমূলক বলে মনে করি৷’’
পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্য প্রত্যাশিতভাবেই অবস্থান করছেন এর একেবারে বিপরীত বিন্দুতে৷ বরং তাঁর মনে হয়, ‘‘বাংলা ভাষা নিয়ে একটা আন্দোলনের প্রয়োজন আছে৷ কারণ দেশ ভাগ হওয়ার পরে পাকিস্তানের গণ পরিষদে যখন তাদের মাতৃভাষা, বা রাষ্ট্রভাষা কী হবে, সে নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছিল, তখন ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নেতৃত্বে বেশ কিছু গুণী মানুষ সেখানে বলেন, যে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও একটা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে হবে৷ তখন ঢাকার যে নবাব ছিলেন, সলিমুল্লা, তিনি বাঙালি হওয়া সত্বেও তার ঘোর বিরোধিতা করেন৷ এবং বাঙালি মুসলমান ওখানে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কেউ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পাশে এসে দাঁড়াননি৷ ফলে একেবারে প্রথমেই বাংলা ভাষা এইভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়৷’’
এর এখন কেন বাংলা ভাষার সংস্কার প্রয়োজন, সেই প্রশ্নে শমীক ভট্টাচার্যর জবাব, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান যে শাসক, তারা জোর করে কিছু শব্দ, কিছু বিষয় চাপিয়ে দিতে চাইছে৷ এর আগেও মুঘল, বা সুলতানি আমলে প্রশাসনিক পরিভাষা, আইন-আদালতের ভাষা হিসেবে বিদেশি শব্দ বাংলা ভাষায় এসেছে৷ সেটা স্বাভাবিক৷ কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে, বাঙালি হিন্দুর যে নিজস্ব পরিচয়, তা কেড়ে নেওয়ার একটা চেষ্টা চলছে, শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক স্বার্থে৷ শমীকের বক্তব্য, ‘‘এখানে ‘আসমানি'শব্দের ব্যবহার ছিল গানে, কবিতায়৷ বহু ক্ষেত্রেই এটা প্রচলিত শব্দ ছিল৷ কিন্তু আমরা আকাশ বলতাম৷ আসমান বলতাম না৷ আবার ‘রামধনু’৷ এটা (আমাদের) শিশুকাল থেকে বাংলা ভাষায় আছে৷ এটাকে রংধনু করে দেওয়া হল!এর উদ্দেশ্যটা কী?’’