ভোক্তারাই পারে ভোক্তার অধিকার নিশ্চিতে বিপ্লব করতে
২৯ জুলাই ২০২২হাত খরচ বা বাড়ি যাওয়ার খরচ তোলার এ রকম সহজ পথ আর আছে বলে আমার মনে পড়ছে না। আপনারা ভাবছেন, কীভাবে? মনে করেন, আমি যদি ভোক্তা অধিকারে অভিযোগ করতাম, তারা দুইটা বাস কোম্পানিকেই জরিমানা করতো। যদি ৫০ হাজার টাকা করেও জরিমানা করতো। তাহলে মোট জরিমানা হতো ১ লাখ টাকা। আর অভিযোগকারী হিসাবে আমি পেয়ে যেতাম জরিমানার ২৫ শতাংশ, অর্থাৎ ২৫ হাজার টাকা। কী সুন্দর সুযোগ না?
তবে অভিযোগটি করতে হতো জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে। নিয়ম মেনে প্রয়োজনীয় প্রমাণসহ এক মাসের মধ্যে অভিযোগ করলে এবং শুনানির দিন হাজির থাকলে মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। অন্তত এই অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা তাদের সেই ভাবমূর্তি গড়তে পেরেছেন।
জনগণের মাঝে এই ভোক্তা অধিদপ্তর নিয়ে কিছু সাধারণ ধারণা গড়ে উঠেছে। যেমন, অনেকের মনে হয়, কোনো কিছুর দাম বেশি নিলেই ব্যবস্থা নিতে পারে এই অধিদপ্তর। এর কারণ হয়ত, সয়াবিনের দাম বেশি নিলে, টিকেটের দাম বেশি নিলে- এরকম ঘটনায় এই অধিদপ্তরের কার্যক্রম খবরের শিরোনাম হয়েছে অনেক বেশি।
অনেক বিষয়ে এখনো হয়ত কোনো অভিযোগ আসেনি। তাই সেটা ভোক্তা সংশ্লিষ্ট হলেও সে বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আবার কিছু বিষয় হয়ত এমন আছে, সেই বিষয়ে ইতিপূর্বে ব্যবস্থা নেয়া হলেও সেটা খুব একটা আলোচিত হয়নি। আর আলোচিত বিষয়ও সমাজের কয়জনই জানে। তাই ঘুরেফিরে কিছু বিষয়ই আমাদের মানসে স্থান করে নিয়েছে।
কিন্তু আসলে ভোক্তা অধিকার তো একটা বিস্তৃত বিষয়। সেটা আমরা কজন জানি। কজন মানি। কেউ যুক্তি দিতে পারেন, ‘সাধারণ মানুষ জানে না। কারণ, ভোক্তা অধিদপ্তর অনেক জায়গায় সক্রিয় নয়।' আবার ভোক্তা অধিকারের লোকজন যুক্তি দিতে পারে, ‘আমরা অভিযোগ না পেলে কীভাবে সক্রিয় হবো?'
এ যেন সৈয়দ মুজতবা আলীর সেই বই কেনা গল্পের চক্রের মতো, ‘বই সস্তা নয় বলে লোকে বই কেনে না, আর লোকে বই কেনে না বলে বই সস্তা করা যায় না'।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন রনি পথে নামার পর রেলওয়ের টিকেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান সহজকে জরিমানা করেছে ভোক্তা অধিদপ্তর। আমার ধারণা, এটা ভোক্তা অধিকার নিয়ে অনেক বড় একটা ক্যাম্পেইনের কাজ করেছে। সহজকে জরিমানার চেয়েও এখানে বড় একটা কাজ হয়েছে। সেটা হচ্ছে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা না পেলেও অভিযোগ করে প্রতিকার পাওয়া যায়- তৈরি হয়েছে এমন একটি আলোচিত দৃষ্টান্ত। টিকেট ব্যবস্থাপনার যে কাজটা সহজ করছে, সেটা যদি রেলওয়ে করতো, তাহলে জরিমানার টাকাটা রেলওয়েকেই দিতে হতো।
সরকারি অফিসে গিয়ে সেবা না পাওয়ার কত কত ঘটনা ঘটে আমাদের চোখের সামনে। সেবা তো দেয়ই না। বরং অনেকে অত্যাচারী জমিদারের মতো আচরণ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবনের সেবা নিয়ে একটা বিখ্যাত মিম আছে। সেখানে সেবা নিতে গেলেই কর্মকর্তা বলে, লাঞ্চের পর আসেন।
একবার আমাকে লাঞ্চের পর যেতে বলা হয়েছিল। অথচ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে আমি তেমন কোনো কাজে ব্যস্ত দেখিনি। মিমে উল্লেখ করা এই ঘটনা সবার সাথেই ঘটে কি-না বা কত শতাংশ মানুষের সাথে ঘটে, সেটা বলার মতো গবেষণার খবর আমার কাছে নেই।
তবে এতটুকু নিশ্চিত করেই বলা যায়, সরকারি অফিসের বহু কর্মকর্তা কেবল সেবা দিতে বিলম্বই করে না। বরং ঘুসও দাবি করে। জনগণের টাকায় লালিত-পালিত কর্মচারী হলেও ছলে বলে কৌশলে জনগণকেই জিম্মি করে। এ রকম প্রতিটা ঘটনায় আমরা যদি অভিযোগ জানাতে শুরু করি, তাহলে দেশে সেবা প্রদানে বিপ্লব হয়ে যাবে।
কী করলে আপনার অধিকার লঙ্ঘিত হবে, সেটার একটা দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। সম্প্রতি আমি রেলের সেবা নিয়ে সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবীর মিলনের সাথে কথা বলছিলাম। তিনি দীর্ঘদিন রেলের সেবা নিয়ে নানা মাধ্যমে সরব আছেন।
তার একটি কথায় আমি চমকে উঠি। তিনি বলেছেন, দাঁড়িয়ে যাত্রী নিলে বসার যাত্রীর অধিকার লঙ্ঘিত হয়। কারণ, বসার যাত্রীরা উঠতে নামতে-বাধার মুখে পড়েন। ঠিকভাবে ওয়াশরুমে যেতে পারেন না।
রেলওয়ে আইনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, রেল কর্তৃপক্ষ এমন কোনো কাজ করতে পারবে না, যাতে বিনা টিকেটে কোনো যাত্রী উঠতে পারে। আবার বিনা টিকেটে ভ্রমণের অজুহাত দেখিয়ে স্ট্যান্ডিং টিকেটও দিতে পারবে না।
আপনাদের কথা আমি জানি না। বিষয়টাকে আমি কোনোদিনই এভাবে ভাবিনি।
সহজের কথায় ফিরে আসি। তাদেরকে কিন্তু এবারই প্রথম জরিমানা করা হয়নি। এর আগে বাসের টিকেটের জন্যও তাদেরকে জরিমানা করা হয়েছিল। ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকই সেটা আমাকে জানিয়েছেন।
এখন ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘনের কাজগুলো কীভাবে থাকবে? বা দৃষ্টান্ত হিসাবে রেলওয়ের কথা যদি বলি, তাদের এই ‘অবৈধ' কাজ কীভাবে থামবে? আমার জবাব হচ্ছে, যদি কাল থেকেই আমরা অভিযোগ জানাতে শুরু করি, তাহলে এটা আজ হোক, কাল হোক; থামবে। একদিন ঠিকই সবকিছু নিয়মে চলবে।
কেউ তখন আর তাচ্ছিল্যভরে বলতে পারবে না যে, ‘এ দেশে কিছু নিয়মে চলে না'। আমার ধারণা এতে সরকারি অফিসে ঘুস বন্ধ হবে, খাদ্যে-ওষুধে ভেজাল বন্ধ হবে, উৎসবে বেশি ভাড়া নেয়া, বেশি মূল্য নেয়া বন্ধ হবে, ক্রেতাদের জিম্মি করতে মজুতদারি বন্ধ হবে, মিথ্যা বিজ্ঞাপন বন্ধ হবে। মোট কথা, ভোক্তা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ অনিয়ম বন্ধ হবে।
তবে সবকিছু ঠিক করতে ভোক্তা অধিকারকে আরো ক্ষমতা দিতে হবে, বদলাতে হবে আইনটাও। সংশ্লিষ্টরা সংশোধিত আইনের একটি খসড়াও এরই মাঝে তৈরি করেছেন। আশা করি, সেটা শিগগিরই পাস হবে। তবে আইনের হাত এখনই যতটুকু লম্বা আছে, সেটা দিয়ে আমরা চাইলেই বহু অনিয়ম বন্ধ করে দিতে পারি। তাতেই ভোক্তা অধিকার নিশ্চিতে বিপ্লব হয়ে যাবে।