মনরো ডকট্রিন ও বিপরীতে ইউরোপকে ব্যতিব্যস্ত রাখার কৌশল
১৮ মার্চ ২০২২কেবল মানুষ হত্যা নয়, তারা চেয়েছে ‘শত্রু দেশটি'র ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতিসমেত তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে৷ এরকম বহু একতরফা হামলার সাক্ষী এই বিশ্ব৷
সেসব তত্ত্ব বা মতবাদের অন্তর্নিহিত কথা হচ্ছে, পৃথিবীতে কেবল আমাদের বিজয় পতাকা উড়বে, তোমাদের নয়৷ আমাদের দিকে চোখ রাঙিয়েছ তো মরেছো৷ তুমি শ্বাস গ্রহণ করতে পারবে, তবে প্রতিটি শ্বাসের সঙ্গে উচ্চারিত হতে হবে আমাদের নাম৷ তোমাকে আমরা করুণা করতে পারি, তবে সমকক্ষ হতে দেবো না৷
মনরো ডকট্রিন বা মনরো মতবাদ নামে একটি তত্ত্বের কথা এখানে উল্লেখ করতে পাারি৷ আজ থেকে প্রায় দুইশ বছর আগে, ১৮২৩ সালের ২ ডিসেম্বর, যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেমস মনরো কংগ্রেসের সপ্তম স্টেট অব ইউনিয়ন ভাষণে এই তত্ত্ব বিশ্ববাসীকে শুনিয়েছিলেন৷ এর মোদ্দা কথা হচ্ছে, উত্তর বা দক্ষিণ অ্যামেরিকার সব দেশই যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থবলয়ের অন্তর্গত৷ কেউ যদি এই গোলার্ধের কোনো দেশের ওপর নজর দেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে তাকে এক হাত দেখে নেওয়ার সব আইনগত অধিকার যুক্তরাষ্ট্রের থাকবে৷
ইতিহাস বলে, মনরো ডকট্রিনে মূলত ইউরোপের দেশগুলোর দিকেই আঙুল তুলেছিল যুক্তরাষ্ট্র৷ লাতিন আমেরিকার অনেক দেশই ছিল ইউরোপের কলোনি৷ প্রকৃতপক্ষে ইউরোপের আগ্রাসন থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে রক্ষা করতেই ওই তত্ত্ব খাড়া করেন প্রেসিডেন্ট মনরো৷ এই তত্ত্ব প্রয়োগ করে ১৮৯৮ সাল থেকে ১৯৯৪ সালের মধ্যে মার্কিন প্রশাসন অন্তত ৪১ বার লাতিন আমেরিকায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অযাচিত হস্তক্ষেপ চালায়৷
বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কতৃর্ত্ববাদী শাসকেরা বলার চেষ্টা করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব শুধু তার নিজের জন্য নয়, সারা ‘মুক্ত বিশ্বের' স্বার্থেই দরকার৷ ২০০৩ সালে ইরাক হামলার আগে সেই তত্ত্বের পুরিয়া বিশ্ববাসীকে গুলে খাওয়ানোর চেষ্টা করেন বুশ জুনিয়র ও টনি ব্লেয়ার জুটি৷
কখনো কখনো এই তত্ত্বের পক্ষে সমর্থনও পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র৷ ১৯০২ সালে ক্যানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী উইলফ্রিড লরিয়ার স্বীকার করেন, মনরো ডকট্রিন তার দেশের নিরাপত্তার জন্য দরকার৷ পক্ষে–বিপক্ষে এরকম বহু উদাহরণ আছে৷
বারাক ওবামা প্রশাসনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জন কেরি একবার বলেছিলেন, মনরো ডকট্রিনের আর প্রয়োজন নেই৷ কিন্তু পরবর্তী সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার এই মতবাদ ফিরিয়ে আনেন৷ রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আবার যেন ফিরে এসেছে এই তত্ত্ব৷ সেটা কিভাবে?
২.
ইউক্রেনে রুশ হামলা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়৷
এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে আরেকটি কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন৷ ‘শত্রু' রাশিয়ার পাশেই ‘ইউক্রেন বন্ধু' পেয়ে গেছে পশ্চিমারা৷ একইভাবে চীনের পাশে পেয়েছে তাইওয়ানকে৷ আবার ‘শত্রু' যুক্তরাষ্ট্রের পাশে রাশিয়া ও চীনের আছে ‘কিউবা বন্ধু'৷ তবে চীন ও রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিউবাকে কম ব্যবহার করে৷ বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তিগুলো যেন প্রতিনিয়তই তাইওয়ান ও ইউক্রেনকে দিয়ে চীন ও রাশিয়াকে প্ররোচিত করতে থাকে৷ কারণ যুদ্ধ শুরু হলেই তাদের সুবিধা৷ বিপুল ব্যয়ে তৈরি অস্ত্রগুলো বিক্রি করা যায়৷ রাজস্ব আয় ফুলেফেঁপে ওঠে৷ এর মধ্য দিয়ে কিছু মানুষ হয়ত মরলো, কিছু স্থাপনা ধংস হলো, এর বেশি কিছু তো নয়!
অনেক বিশ্লেষকের মতে, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা মোটাদাগে পশ্চিমাদের সেই ইচ্ছারই প্রতিফলন৷
এ ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের আছে ন্যাটো সামরিক জোট৷ পশ্চিমারা নিঃসন্দেহে রাশিয়াকে হুমকি মনে করে৷ অনেকেই রাশিয়াকে ‘খাঁটি ইউরোপীয়' দেশ বলেও স্বীকার করতে চান না৷
অপরদিকে রাশিয়া মনে করে, আটলান্টিকের দুই পারের দেশগুলোই তার প্রকৃত শত্রু, তার অস্তিত্বের পক্ষে ক্ষতিকারক৷ যে কোনোভাবে এদের ঠেকিয়ে রাখতে হবে৷ ন্যাটো এদেরই সামরিক জোট৷ তার প্রতিবেশী ইউক্রেন এই ন্যাটোরই সদস্যপদ পেতে চায়৷ ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্যপদ পেলে সীমান্তে রাশিয়ার দিকে তাক করে ক্ষেপনাস্ত্র বসাতে পারবে৷ অর্থাৎ, রাশিয়া মনে করে, ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্য পদ প্রাপ্তির অর্থ হচ্ছে, শত্রুকে পথ দেখিয়ে বাড়িতে ডেকে আনা৷ সুতরাং এটা কোনোভাবেই করতে দেওয়া যাবে না৷ ইউক্রেনের সাবেক কৌতুক অভিনেতা প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কিকে থামাতে হবে, একটা চরম শিক্ষাও দিতে হবে৷ অতএব চালাও হামলা৷
এভাবে ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রত্যুষে তিন দিক থেকে ইউক্রেনে অভিযান শুরু করেন ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন৷ যে যুদ্ধ এখন চলছে৷ নারী, শিশুসহ অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি হয়েছে৷ নেটফ্লিক্স দেখা, ব্লন্ড চুলের ইউক্রেনীয়রা আগুনে পুড়তে থাকা আপন গৃহকোণের দৃশ্য বুকে চেপে রেখে পোল্যান্ডগামী ট্রেনে চড়ে বসছেন৷ জার্মানিসহ ইউরোপের দেশগুলোতে জুটেছে তাদের আশ্রয়৷ ভাগ্য ভালো, সিরীয় শরণার্থীদের মতো সীমান্তে কাঁটাতারে তীব্র শীতের মধ্যে দিনের পর দিন আটকে থাকতে হয়নি, পানির গভীরে তলিয়ে যেতে হয়নি ৫ বছরের আয়লান কুর্দির মতো কোনো শিশুকে৷ তারা আশ্রয় পেয়েছেন কিছুটা সম্মানের সঙ্গে, কেউ কেউ তাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে গোলাপও৷
৩.
একটু আগে মনরো ডকট্রিনের কথা বলছিলাম৷ ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আবারো যেন ফিরে এসেছে কথিত এই তত্ত্ব৷ শুরুতে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে কোনো কিছু না বলার কৌশল গ্রহণ করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন৷ আস্তে আস্তে খুলে পড়ছে ঝানু এই রাজনীতিকের টিকি৷ পুতিনকে বলেছেন যুদ্ধাপরাধী৷ ঠান্ডা মাথার পুতিনও পাল্টা তীর ছুঁড়েছেন৷ একদিকে কিয়েভ, খারকিভ, মারিউপোলের মতো রোমান্টিক সব নগরী ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে, অন্যদিকে চলছে উত্তেজনা আরো বাড়ানোর সব আয়োজন৷
সেগুলো কি কি একটু দেখে নেওয়া যাক৷
ক. ইউক্রেনকে ৮০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র৷ দেওয়া হবে স্টিংগার নামে ৮০০টি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা৷ ভূমি থেকে আকাশে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম দুই হাজার জ্যাভলিন ক্ষেপনাস্ত্র৷ আরো অন্যসব ভারী অস্ত্র তো আছেই৷
খ.যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু যুক্তরাজ্য ঘোষণা দিয়েছে, তারা ইউক্রেনের বন্ধু রাষ্ট্র পোল্যান্ডে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘স্কাই সেভার' মোতায়েন করবে৷ পূর্ব ইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ন্যাটো যে পদক্ষেপ নিয়েছে তার অংশ হিসেবেই স্কাই সেভার মোতায়েন করা হচ্ছে৷
গ. যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ছাড়াও ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে জার্মানি, ফ্রান্স, বেলজিয়ামসহ বিভিন্ন দেশ৷
ঘ. পুরোপুরি অস্ত্রের খোঁজে নেমে গেছে ইউরোপের দেশগুলো৷ ৩৫টি এফ ৩৫ যুদ্ধবিমান কিনতে যুক্তরাষ্ট্রের লকহেড মার্টিন কর্পোরেশনের সঙ্গে চুক্তি করতে যাচ্ছে জার্মা৷নি৷ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে রিপার ড্রোন কিনতে চাচ্ছে পোল্যান্ড৷
এসব তথ্য দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না লাভের গুড় কোন পিঁপড়া খাওয়ার জন্য ওঁত পেতে আছে৷ ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইউরোপকে ব্যতিব্যস্ত রেখে অস্ত্র বিক্রি করে বিপুল পরিমাণে ডলার কামানোর এক অতি চমৎকার কৌশল বের করেছেন জো বাইডেন৷ এ যুদ্ধে রাশিয়া হারলে যুক্তরাষ্ট্র লাভবান, জিতলেও তার ক্ষতি নেই৷ আসছে পরমাণু অস্ত্র হামলার আশঙ্কার কথা, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা৷ সম্ভবত, করোনা– উত্তর বিশ্বে এ যুদ্ধে মানুষ ছাড়া আর কারো পরাজয় হবে না৷
৪.
কিন্তু এ যুদ্ধের একটা বড় প্রভাব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইতিমধ্যে পড়া শুরু হয়েছে, বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলোতে৷ সামনে আরো দীর্ঘস্থায়ী ছায়া ফেলবে এই যুদ্ধ৷ রাশিয়া ও ইউক্রেনের গমের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলো সংকটে পড়ে যাবে৷ বেড়ে যাবে খাদ্যপণ্যের দাম৷ আফ্রিকার অনেক পরিবারে চুলা জ্বলবে না হয়ত৷ জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম ইতিমধ্যে বেড়ে গেছে৷ সামনে আরো শোচনীয় অবস্থার জন্য তৈরি থাকতে হবে৷
অস্ত্র ক্রয়ে বেশি টাকা খরচ হয়ে যাওয়ায় এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকায় ধনী দেশগুলোর সহায়তা কমে যাবে৷ আরো অপুষ্ট হবে জাতির ভবিষ্যত শিশুরা৷ দুর্বল হয়ে পড়বে টিকা কার্যক্রম৷ জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজনে যে বাজেট বরাদ্দ থাকে, তা আরো সীমিত হয়ে পড়বে৷ বাড়তে থাকবে জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা৷ সার্বিকভাবে গবেষণায় মনোযোগ কমে যাবে৷
সমস্ত বিকল্পের জন্য আগামী দিনগুলোতে প্রস্তুত থাকতে হবে বিশ্বকে৷ এক সময় হয়ত বিকল্পও সীমিত হয়ে পড়বে৷ তখন আসবে বিকল্পেরও বিকল্প৷
এই মুহূর্তে কবীর সুমনের একটা গানের কথা খুব মনে আসছে৷ গানটি মনে মনে যেন আওড়াচ্ছি, ‘বাহবা সাবাস বড়দের দল এই তো চাই /ছোটরা খেলবে আসুন আমরা বোমা বানাই৷'