মশা আর মশাবাহিত রোগ ছিল, আছে, থাকবে
১২ মার্চ ২০২১প্র্যাকটিসে কী না হয়৷ আমার এক বন্ধুর এক বছরে দুই বার ম্যালেরিয়া হওয়ার পর সে মশা দেখলেই মারতে শুরু করলো৷ ক্রমশ, মশা মারায় এমন দক্ষ হয়ে গেল, তার বাড়িতে কোনো মশা টিকতে পারতো না৷ দেখলেই মারতো৷ আমার অবশ্য এক বছরে তিনবার ম্যালেরিয়া হয়েছে৷ কাঁপতে কাঁপতে ক্লোরোকুইন গিলতে হয়েছে৷ তারপরে চেষ্টা করেও মশা মারার দক্ষতা লাভ করতে পারিনি৷ আমার অবস্থা পুরসভার মশা মারা প্রকল্পের মতো৷ প্রচুর ধোঁয়া দিয়ে গাড়ি চলে যায়৷ মাঝে মাঝে পিঠে বিচিত্র এক যন্ত্র নিয়ে চারপাশে তেল ছড়াতে ছড়াতে কর্মী চলে যান৷ উদ্যোগ-আয়োজনে ফাঁক নেই৷ কিন্তু মশা যায় না৷ মশার বংশ নির্বংশ করতে ধোঁয়া ছড়ালে, একদিকের মশা অন্যদিকে যায়, এইমাত্র৷ তারপর তাদের ফিরে আসতে খুব বেশি সময় লাগে না৷ ফলে অবস্থা যে কে সেই৷ আমিও মশা মারার চেষ্টা করলে তা দুই হাতের ফাঁক দিয়ে ঠিক গলে যায়৷
দিল্লিতে আবার ম্যালেরিয়া কম, ডেঙ্গু বেশি৷ তার কী প্রতাপ! পাড়ায় কারো ডেঙ্গু হয়েছে জানলে প্রতিবেশী তো বটেই, বকিরাও জানলা, দরজা নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া খোলেন না৷ সকালে বারান্দায় বসে চায়ের কাপসহ খবরের কাগজ পড়াও বন্ধ৷ ডেঙ্গুর মশা কামড়ে দিলেই সর্বনাশ৷ মাঝেমধ্যে আবার শুরু হয় চিকনগুনিয়ার তাণ্ডব৷ রক্তচোষা ওই ছোট্ট একরত্তি মশার ক্ষমতা দেখে তাজ্জব হয়ে যেতে হয়৷ অবশ্য এখন করোনা ভাইরাসের ক্ষমতার তলায় মশা একটু চাপা পড়ে গেছে৷ কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে মানুষের মনে ভয় ধরিয়ে মশা রাজত্ব করে গেছে৷ সেই রাজত্বের পতন এখনো হয়নি৷ মশাদের তো অমর করে দিয়ে গেছেন জীবনানন্দ তার কবিতায়৷ মশা তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালোবাসে৷ তবে হক কথাটা বলেছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায়-- দেশান্তরী করল আমায় কেশনগরের মশায়৷
মশা দেশান্তরী না করলেও এখনো আতঙ্ক ছড়িয়ে যাচ্ছে৷ আমার মতো তিনবারের ম্যালেরিয়া হওয়া লোকের তো বটেই, যাদের হয়নি, তাদেরও ভয় কম নয়৷ আর ভারতের রাজধানী শহরে গরম মানেই মশা, বর্ষা মানে আরো বেশি মশা, শীতের শুরুতেও মশা, হাড় কাঁপানো শীত ছাড়া এমন আর একটিও সময় নেই, যখন মশা থাকে না৷ ম্যালেরিয়া-ট্যালেরিয়ার ভয় থাকে না৷
তাও তো ম্যালেরিয়ার মোকাবিলায় সাফল্য পেয়েছে ভারত৷ স্বাধীনতার পর সাড়ে সাত কোটি মানুষ প্রতিবছর ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হতেন৷ ২০২০ সালে আক্রান্ত হয়েছেন এক লাখ ৫৭ হাজার ২৮৪ জন, যা ২০১৯-এর তুলনায় ৪৫ শতাংশ কম৷ এরকম চলতে থাকলে ২০৩০ সালে ম্যালেরিয়া-মুক্ত হওয়ার লক্ষ্য়ও পূরণ হতে পারে৷
ম্যালেরিয়া কমছে ঠিকই, মশা নয়৷ আর আসছে নতুন নতুন রোগ৷ ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জাপানি এনকেফেলাইটিস৷ ডেঙ্গু কোনো একবছর কম থাকে, পরের বছর বেড়ে যায়৷ সরকারি হিসাব বলছে, ২০১৮ সালে ভারতে এক লাখের বেশি মানুষের ডেঙ্গু হয়েছিল৷ তার পরের বছর তা দেড় লাখ ছাড়িযে যায়৷ গত বছর নভেম্বর পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৩৩ হাজার মানুষ৷ তাহলে কি এই বছর আবার ডেঙ্গু বাড়বে? সরকার আশ্বস্ত করে বলছে, বাড়বে না৷ মানুষ উদ্বেগে আছেন৷
ন্যাশনাল ভেক্টর বোর্ন ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম চিকুনগুনিয়া নিয়ে যে সংখ্যাতত্ত্ব দিয়েছে তাতে দুইটি ভাগ আছে৷ একটি হলো, যাদের চিকুনগুনিয়া হয়েছে এবং যাদের হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে৷ সন্দেহের তালিকায় অনেক বেশি মানুষ৷ সেই সংখ্যা কখনো এক লাখের বেশি, কখনো আড়াই লাখ ছাড়িয়েছে, কোনো বছর আবার ৬৪ হাজারে থেমে গেছে৷ উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের গোরক্ষপুর তো এনকেফেলাইটিসের জন্য বিখ্যাত ছিল৷ সাংসদ থাকার সময় লোকসভায় বহুবার তিনি এই প্রসঙ্গ তুলেছেন৷ কেন তা নির্মূল করা যাচ্ছে না, সেই প্রশ্নও তুলেছেন৷ ভারতের গ্রামগঞ্জের মানুষের ম্যালেরিয়া হলে তা যে সরকারি নথিতে উঠবেই, এমন পরিকাঠামো এখনো এদেশে তৈরি হয়নি৷
মোটকথা, মশা আছে৷ মশাবাহিত রোগ আছে৷ ডেঙ্গুর মশা হয় পরিষ্কার জলে৷ দিল্লিতে দীর্ঘ প্রচার চালিয়েছে কেজরিওালের সরকার৷ বাড়িতে, বাড়ির সামনে জল জমতে দেবেন না৷ দিলেই ডেঙ্গুর মশা হবে৷ কিন্তু দিল্লি জুড়ে পরিষ্কার ও নোংরা জলের কোনো অভাব নেই৷ না আছে লোকের সচেতনতা, না আছে পুরসভার সেই যুদ্ধকালীন তৎপরতা৷ ফলে মশা আছে, মশা থাকবে, এটাই ভবিতব্য৷ আর মশা থাকলে মশাবাহিত রোগও থাকবে৷ তাই মশা ও মশাবাহিত রোগ নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে৷