মাদার টেরেসাকে নিয়ে হিন্দু নেতার মন্তব্যে বিতর্কের ঝড়
১ মার্চ ২০১৫নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার গঠন করলে ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প আরো বেশি ছড়াতে পারে – অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মনে এ আশঙ্কা ছিল৷ আশঙ্কা ভুল হয়নি৷ বিজেপি সরাসরি এমন কর্মে খুব একটা লিপ্ত না হলেও হিন্দুত্ববাদী অন্য কিছু সংগঠন এ সব কাজে নেমে পড়েছে কোমর বেঁধে৷ ‘ঘর ওয়াপসি'-র কথা বলে খ্রিষ্টান এবং মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করা হয়েছে৷ এ নিয়ে বিতর্ক হয়েছে৷ কিন্তু ক্ষমতাসীন বিজেপি এ সব বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেয়নি৷ অন্তত সাতটি গির্জাতেও হামলা হয়েছে ভারতে৷ হামলা বন্ধে সরকারি আশ্বাস সংখ্যালঘুদের মনে কোনো ভরসার জন্ম দেয়নি৷
ভারতের অবিসংবাদিত নেতা মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে কটুক্তিও করা হয়েছে ভারতে৷ এক বিজেপি নেতা মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসেকেই বরং ‘দেশপ্রেমিক' হিসেবে বর্ননা করেছেন৷ এ নিয়েও বিতর্ক কম হয়নি৷ তবে নরেন্দ্র মোদীর দল রাষ্ট্রীয় নেতার চরিত্রহনন এবং একজন হত্যাকারীকে মহিমান্বিত করার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়নি৷ বিশ্বের সবচেয়ে গণতান্ত্রিক দেশ বলে পরিচিত ভূখণ্ডটিতে আবার শুরু হয়েছে তোলপাড়৷ এবার বিষয় – মাদার টেরেসা৷
জীবদ্দশায় কলকাতার বহু বস্তির অনেক অনাথ শিশুর মুখেই হাসি ফুটিয়েছেন মাদার৷ সম্প্রতি রাজস্থানে একটি অনাথ আশ্রম উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসস)-এর নেতা মোহন ভাগবত৷ সেই অনুষ্ঠানে নোবেল বিজয়ী মাদার টেরেসা সম্পর্কে সংগঠনটির এই নেতা বলেন, ‘‘মাদার টেরেসা যেমন সেবা দিতেন আমরা এখানে সেরকম সেবা দেবো না৷ উনি যেসব কাজ করে গেছেন তা ভালো হতে পারে, তবে সে কাজের পেছনে একটা বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল৷ উদ্দেশ্যটা ছিল যাদের সেবা করবেন তাদের ধর্মান্তরিত করে খ্রিষ্টান বানানো৷''
এক বিশ্বনন্দিত মানবদরদী সম্পর্কে মোহন ভাগবতের এই উক্তির পর স্বভাবতই তোলপাড় শুরু হয়েছে ভারতে৷ এর নিন্দা জানিয়েছেন অনেকেই৷ খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের অনেকে এক হিন্দু নেতার এমন উক্তিকে ‘ভুল তথ্য' এবং ‘অজ্ঞানতা প্রসূত' বলে খারিজ করলেও পাশাপাশি এসব বলে উগ্রতা ছড়ালে ভারতে তাদের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন৷ তাঁদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সারা বিশ্বে মাদার টেরেসার মোট ৭৪৫টি ‘হোম' বা আশ্রম আছে৷ তিনি জীবনের বেশির ভাগ সময় যেখানে কাজ করেছেন, সেই কলকাতায় আছে ১৯টি৷ সেখানে যাঁদের সেবা করা হয়, তাঁদের ৯০ ভাগেরও বেশি মানুষই অন্য ধর্মের, অর্থাৎ তাঁরা খ্রিষ্টান নন৷
আরএসএস দাবি করে, তারা অরাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সংগঠন৷ তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই সংগঠনটির মাধ্যমে যে বিশ্বাস বা দর্শন ছড়ানোর চেষ্টা চলছে, তা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সঙ্গেই মেলে৷ তাছাড়া হিন্দুত্ববাদী দলগুলোর সঙ্গে এদের সম্পর্কও ঐতিহাসিক এবং ঘনিষ্ঠ৷ অতীতে জাতীয় পর্যায়ের অনেক হিন্দুত্ববাদী নেতা, এমনকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীরও আরএসএস-এর সঙ্গে কোনো না কোনো ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন৷ বিজেপিতে যোগ দেয়ার আগে আরএসএস-এর হয়ে কাজও করেছেন মোদী৷
মোদীর শাসনামলে আরএসএস এবং সমমনাদের বাজার রমরমা হবে এ আশঙ্কার তাই জোরালো ভিত্তি ছিল৷ ভারতের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং মৌলবাদের বিরোধী শক্তিরা সে বিষয়ে বেশ সজাগ৷ মাদার টেরেসাকে খাটো করার অপচেষ্টার বিরোধীতা করছেন অনেকেই৷ আম আদমি পার্টির নেতা, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল টুইটারে লিখেছেন, ‘‘কলকাতার নির্মল হৃদয় আশ্রমে আমি মাদার টেরেসার সঙ্গে কয়েক মাস কাজ করেছি৷ মহৎ প্রাণের মানুষ ছিলেন তিনি৷ দয়া করে তাঁকে অন্তত রেহাই দিন৷''
মোহন ভাগবতের মন্তব্য সংসদেও উত্তেজনা ছড়িয়েছে৷ বিরোধী দলের সাংসদরা এ মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন কঠোর ভাষায়৷ কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্ক্সিস্ট) দলের সাংসদ পি রাজিব তীব্র ভাষায় নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, ‘‘ওরা আমাদের আইকনদের সুকৌশলে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে৷ প্রথমে গান্ধীর চরিত্র হননের চেষ্টা করেছে, এবার লেগেছে মাদার টেরেসার পেছনে৷'
বিজেপির সবাই চুপ করে নেই৷ বিরোধীতা না করে মোহন ভাগবতকে প্রকারান্তরে সমর্থনও করছেন কেউ কেউ৷ বিজেপির সাংসদ মিনাক্ষী লেখি একদিকে আরএসএস-এর সঙ্গে তাঁর দলের দূরত্ব বাড়ানোর প্রয়োজনের কথা বললেও, অন্যদিকে বলেছেন, ‘‘দেখুন বেঁচে থাকতে মাদার টেরেসা নিজেও বহুবার বলেছেন, তাঁর মূল কাজ খ্রিষ্টান ধর্মকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া৷''