মানসিক অসুস্থতা
৩ নভেম্বর ২০১৫আমি যে কলকাতায় মানুষ, সে কলকাতার বহু বাড়িতে একজন না একজন করে বিধবা বা একজন করে ‘পাগল' থাকতেন৷ তাদের সবাই যে ভীতিকর রকম পাগল ছিলেন, এমন নয়৷ হয়ত কোনো মুদ্রাদোষ কিংবা ছোটখাট পাগলামি ছিল৷ অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট চরিত্রটির ব্যক্তিত্বে এমন কোনো ঘাটতি বা খুঁত ছিল, যার কারণে মানুষজন তাকে ‘সিরিয়াসলি' নিত না; ‘পাগলে কি না বলে, ছাগলে কি না খায়' বলে তার কথা উড়িয়ে দেওয়া যেত; বাড়িতে আচার-অনুষ্ঠান হলে তাকে কলাপাতার ‘ইন-চার্জ' করে দেওয়া হতো৷
এই ধরনের একটি পারিবারিক পাগলের যে আবেগ-অনুভূতি আছে, তা জানা থাকলেও, তা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামানোর প্রয়োজন পড়ত না৷ যেন ভাঙা পাত্তর, তবুও মানুষ তো; তাই ফেলে না দিয়ে, তুলে রাখা হয়েছে, মাঝেমধ্যে নামিয়ে একটু ঝাড়পোঁছ, নাড়াচাড়া করলেই কাজ চলে যায়৷ হয়ত বাল্যকালে স্বামী চলে গিয়ে পিসির (ফুপু) মাথাটা খারাপ হয়েছে – যদিও তা সত্ত্বেও পিসির হাতের মুগের ডাল খেয়ে লোকে পাগল! হয়ত ঠাকুরদা পূর্ববঙ্গের কোনো অজ পাড়াগাঁয়ের সম্পত্তি, জমিজমা সব খুইয়ে এখনও স্টিলের কালো বাক্সে সেই সব তামাদি হয়ে যাওয়া দলিলপত্র আগলে আছেন৷
এরা সব হলেন ‘হার্মলেস' পাগল৷ আবার উদ্দাম পাগল, খিঁচুনি লাগা পাগল, মারধোর করা পাগল, এ সবও ছিল৷ যা ছিল না, সেটা হলো, কখনও কাউকে বলতে কিংবা জিগ্যেস করতে শুনিনি: আচ্ছা, পাগল কথাটার মানে কী, আর পাগলামিই বা কী বস্তু? ওটা কি কোনো রোগ না বিকার? পাগলামি কি ভালো হয়? সুকুমার রায়ের পাগলা দাশু কী ধরনের পাগল ছিল? কমলা মাসির (খালা) বড়ছেলেটা প্রেমে পড়ে পাগল হয়েছিল৷ দাড়ি কামানো ছেড়েছিল৷ বাড়ি থেকে বেরত না৷ কমলা মাসিকে বলত, ‘‘মা, আমি দেবদাস হইচি৷'' পরে ও পাড়ার টুনির সঙ্গে বিয়ে দেওয়ায় সেই পাগলামো কাটল৷
শুনেছি, আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে নাকি পাগল – অর্থাৎ মানসিক রোগীদের একটা আলাদা ওয়ার্ড ছিল৷ জেলের মনস্তত্ত্ববিদ লাঠিধারী ওয়ার্ডার সহযোগে সেই সব রোগী দেখতে যেতেন৷ রাঁচির পাগলা গারদ নিয়ে যত ‘জোক' শুনেছি, লুম্বিনি নিয়ে তো ততটা শুনিনি – কিন্তু কেন? পাগলামিটা কি নাট্যশাস্ত্র, কখনো কমেডি, আবার কখনো ট্র্যাজেডি?
মেয়ের জন্য বর খুঁজতে গিয়ে সে আমলে লোকে খোঁজ করত, বংশে কোনো ‘সুইসাইড' বা পাগল আছে কিনা৷ যেন পাগলামিটা বংশগত! যদি অভিনয় কিংবা গানের গলা বংশগত না হয়, তবে পাগলামিই বা বংশগত হতে যাবে কেন? আসলে একটা মানুষ তার পারিপার্শ্বিকের আর পাঁচটা মানুষের মতো ব্যবহার না করে, আচার-আচরণ না করে, একটু উদ্ভুটে ব্যবহার, আচার-আচরণ করছে৷ সেই উদ্ভুটে আচার-আচরণ বুঝতে গেলে তার ব্যক্তিগত ইতিহাস, আশা-আকাঙ্খা, আশাভঙ্গ ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে হবে; হয়ত তাকে (মানসিক) ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে, খরচপাতি হবে, বদনাম হবে; আর রোগ সারলে বা কমলেই বা হবেটা কী? ফুটো ঘটিতে আর কতটা জল ধরবে? পাগল মানুষ কি জজ হবে, না ব্যারিস্টার হবে? মন্ত্রী হবে না সান্ত্রী হবে? পাগল সারানোর চেষ্টা মানেই তো পণ্ডশ্রম...৷
বাড়িতে কোনো প্রবীণ বা প্রবীণার যখন ঘোর অসুখ, তখন ডাক্তার ডাকতে গিয়ে কি ভাবেন: এঁর আর ক'টা দিন? ওষুধপত্রের পিছনে টাকা ঢালার কোনো অর্থ হয় কিনা? তাহলে আমরা শেষমুহূর্ত পর্যন্ত সেই প্রায় চলে যাওয়া মানুষটিকে ধরে রাখার চেষ্টা করি কেন? মানুষটিকে ভালোবাসি বলে, আর আমরা নিজেরা মানুষ বলে৷
পাগলামিকে মানসিক রোগ হিসেবে দেখা আর সেই রোগ সারানোর প্রচেষ্টা করা প্রয়োজন আমাদের নিজেদের মনুষ্যত্ব বাঁচানোর তাগিদে৷ পাগলের তা-তে কিছু আসে যায় না৷
লেখকের সঙ্গে কি আপনি একমত? জানান নীচে মন্তব্যের ঘরে...