মাশরাফি কি কোনো ভুল করেছেন?
২৯ এপ্রিল ২০১৯সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাশরাফির বিপক্ষে অবন্থান নিয়ে নানা সমালোচনা এবং ট্রল করছেন কিছু চিকিৎসক৷ তবে মাশরাফির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী সাধারণ মানুষ৷ তাঁদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক এখন তুমুল পর্যায়ে, যা অনেকটা খিস্তিতে রূপ নিয়েছে৷ চিকিৎসকদের দু-একজন মাশরাফির যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন৷ বলেছেন, ‘‘মাশরাফি পারলে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়ে দেখান৷''
মাশরাফি হাসপাতালে যান শনিবার৷ তিনি সেখানে গিয়ে চার জন চিকিৎসককে অনুপস্থিত দেখতে পান৷ এরপর রোগী সেজে এক চিকিৎসককে ফোন করলে তিনি রবিবার এসে চিকিৎসা নিতে বলেন৷ এরপর তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে ওই চিকিৎসককে বলেন, ‘‘এখন যদি হাসপাতালে সার্জারির প্রয়োজন হয়, তাহলে সেই রোগী কী করবে?'' সেই চিকিৎসককে তাঁর কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে দ্রুত কর্মস্থলে ফিরে আসতে বলেন মাশরাফি৷
ওই চিকিৎসকদের হাজিরা খাতাও দেখেন মাশরাফি৷ সেখানে তাঁদের হাজিরা ছিল না,এমনকি তাঁদের ছুটির কোনো দরখাস্তও পাননি তিনি৷
এরপর তিনি নারী ও শিশু ওয়ার্ডে রোগীদের সাথে কথা বলে তাঁদের কাছ থেকে নানা ধরনের সমস্যার কথা শোনেন৷ ওই সময় পুরো হাসপাতালে মাত্র একজন ডাক্তারকে পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি৷
ওই ঘটনার পর মোট চারজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর৷ নড়াইল সদর হাসপাতালের সার্জারির সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মো. আখতার হোসেন ও ডা. মো. রবিউল আলম এবং মেডিকেল অফিসার ডা. এ এসএম সায়েমকে ওএসডি করা হয়৷ আর কার্ডিওলজির জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মো. শওকত আলীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে৷
এখন এসব নিয়েই চলছে আলোচনা-সমালোচনা৷ সাংবাদিক শেরিফ আল সায়ার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মাশরাফি একজন সংসদ সদস্য হিসেবে যা করেছেন, ঠিকই করেছেন৷ তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন৷ তবে আমার মনে হয়েছে, ভাষা বা শব্দ প্রয়োগে তিনি আরেকটু সতর্ক হতে পারতেন৷''
তিনি বলেন, ‘‘মাশরাফি নড়াইলের সরকারি হাসপাতালে যা দেখেছেন, তা বাংলাদেশের প্রায় সব সরকারি হাসপাতালের চিত্র৷ হাসপাতালে অধিকাংশ সময়ই চিকিৎসক থাকেন না৷ তাঁরা ব্যস্ত থাকেন প্রাইভেট প্র্যাক্টিস নিয়ে৷ এর একটা সুরাহা হওয়া প্রয়োজন৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘মাশরাফি কোনো অন্যায় করেননি৷ হাসপাতালে গিয়ে কোনো ভুল করেননি৷ যারা তাঁকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আক্রমণ করছেন, তারা সবাই চিকিৎসক৷ আমরা অতীতেও দেখেছি চিকিৎসকদের কোনো অনিয়ম বা অবহেলার কথা কেউ বললে চিকিৎসকরা সবাই মিলে তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন৷''
আর কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশর অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মাশরাফি তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন৷ একজন এমপি হিসেবে এলাকার লোকজনের সমস্যা, এলাকার হাসপাতালের সুযোগ-সুবিধা দেখা তাঁর দায়িত্ব৷ তিনি হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে দায়িত্ববোধেরই পরিচয় দিয়েছেন৷ প্রশংসার কাজ করেছেন৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘শুধু সরকারি চিকিৎসক নয়, যে-কোনো সরকারি চাকরিজীবীই যদি অননুমোদিতভাবে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে৷ আর কেউ কেউ আছেন যাদের এটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে৷ তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘চার ডাক্তারকে যে ওএসডি করা হয়েছে, এটা কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নয়৷ ওএসডি কোনো শাস্তি নয়৷ তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া দরকার৷''
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)-র সাধারণ সম্পাদক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সংসদ সদস্য হিসেবে মাশরাফি বিন মোর্তজার হাসপাতাল পরিদর্শন এবং চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া ঠিক আছে৷ তবে এর মাঝখানে কিছু বিষয় আছে৷ বিষয় হলো তাঁর ভাষা৷ তিনি বোধহয় নতুন সংসদ সদস্য হিসেবে ভাষাটা রপ্ত করে উঠতে পারেননি৷ সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে চিকিৎকের যা হবার তা হবে৷ সরকার ব্যবস্থা নেবে৷ কিন্তু মাশরাফি তাকে বলতে পারেন না যে, আমি আপনাকে কী করতে পারি৷ এটা প্রকারান্তরে হুমকি৷ তিনি চিকিৎসককে কী করতে পারেন? এছাড়া তিনি ‘ফাজলামি' শব্দটা ব্যবহার করেছেন৷ একজন সংসদ সদস্যের মুখে ফাজলামি শব্দটা মানায় না৷ এটাও এক ধরনের ফাজলামি৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘কোনো চিকিৎসক তার চাকরিবিধি ভঙ্গ করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ কিন্তু চিকিৎসকের ডিউটিটা বুঝতে হবে৷''
গত জানুয়ারি মাসে দুদক দেশের বিভিন্ন এলাকার ১০ হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে ৬২ শতাংশ চিকিৎসককে কর্মস্থলে পায়নি৷ ২১ জানুযারি সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ১০টি হাসপাতালে দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযান চালিয়ে এই তথ্য জানায়৷ সেবার ঢাকা, রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, পাবনায় মোট ১০টি সরকারি হাসপাতালে একযোগে অভিযান পরিচালনা করে দুদক এনফোর্সমেন্ট টিম৷
এ প্রসঙ্গে ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘‘আমরাও মন্ত্রণালয়ে জানতে চেয়েছি, দুদকের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কী ব্যবস্থা নেয়া হলো৷ যদি কোনো অনিয়ম হয়ে থাকে, তাহলে তো ব্যবস্থা নিতে হবে৷ আসলে চিকিৎসকরা রোস্টার ডিউটি করেন৷ ২৪ ঘণ্টা ডিউটি ভাগ করা হয়৷ তাই সবাইকে এক সময়ে হাসপাতালে পাওয়া যাবে না৷ কেউ সকালে, কেউ দুপরে, কেউ রাতে দায়িত্ব পালন করেন৷ এটা জানতে এবং বুঝতে হবে৷''