মুক্তিযুদ্ধের সাহসী কণ্ঠযোদ্ধা মঞ্জুশ্রী নিয়োগী
৪ জুন ২০১১‘‘বাংলাদেশ ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হলেও যশোর স্বাধীন এবং মুক্ত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর৷ সেদিন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে বিজয় সমাবেশে সংগীত পরিবেশন করতে আমিও যশোর যাই৷ আমরা সেখানে পৌঁছানোর পর দেখলাম, বাঙ্কার খুলে দেওয়া হয়েছে৷ সেখানে অনেক নারীকে আটক করে রেখেছিল পাকিস্তানি সেনারা৷ তারা মুক্তি পেয়ে, তাদের উপর চালানো নির্মম নির্যাতনের কথা বলার জন্য আমাদের কাছে আসল৷ দেখলাম তাদের শরীরে অজস্র দাঁতের কামড় ও নির্যাতনের দাগ৷ এক কথায় ছিন্নভিন্ন শরীর৷ তাদের কষ্টের কথা শুনে হাহাকার করে ওঠে আমাদের হৃদয়-মন৷'' ডয়চে ভেলের কাছে এভাবেই স্বাধীনতা যুদ্ধের ছবি তুলে ধরলেন কণ্ঠযোদ্ধা মঞ্জুশ্রী নিয়োগী দাশ গুপ্ত৷
১৯৪৫ সালের ১০ অক্টোবর শেরপুরে জন্ম মঞ্জুশ্রী নিয়োগীর৷ বৈবাহিক সূত্রে মঞ্জুশ্রী দাশ গুপ্তা নামেও পরিচিত তিনি৷ বাবা বিপ্লবী রবি নিয়োগী এবং মা বিপ্লবী জ্যোৎস্না নিয়োগী তেভাগা আন্দোলন ও টংক আন্দোলনসহ নানা আন্দোলন সংগ্রামে জীবন বাজি রেখে নেতৃত্ব দিয়েছেন আমৃত্যু৷ তাই জন্মসূত্রেই বিপ্লব আর আন্দোলনের চেতনা মিশে ছিল মঞ্জুশ্রীর রক্তে৷ বাবা-মায়ের পদচিহ্ন অনুসরণ করে তিনিও ছোট্ট থেকেই চলছেন সংগ্রামের কণ্টকময় পথ ধরে৷ বাংলাদেশের স্বাধীনতাপূর্ব, যুদ্ধকালীন এবং স্বাধীন বাংলাদেশেও তাই সমানভাবে আন্দোলন আর সংগ্রামের সামনের সারিতে রয়েছেন তিনি৷ তবে তাঁর লড়াই-সংগ্রাম খুব বেশি করে ঘুরেছে বাংলার এবং বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে ঘিরে৷ একজন সংগ্রামী সুর সৈনিক হিসেবে তিনি গণসংগীতের দামামা বাজিয়েছেন, সুর-সংগীতের মাধ্যমে বাঙালি জাতির রক্তে জাগিয়েছেন বিপ্লবের আগুন৷
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে তিনি স্নাতক শেষ করে ঢাকায় সমাজ কল্যাণ বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য ভর্তি হন৷ কিন্তু যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে লেখা-পড়া বন্ধ করে ছুটে যান শেরপুরে৷ সেখানে মুক্তিযুদ্ধের জন্য গঠিত সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদে যোগ দেন তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী মঞ্জুশ্রী৷ শেরপুর মুক্ত থাকা পর্যন্ত প্রায় একমাস সেখানে সভা-সমাবেশ করে এলাকাবাসীকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন৷ কিন্তু পাক সেনারা শেরপুরেও হানা দিলে, ২২ এপ্রিল মেঘালয় সীমান্ত দিয়ে তাঁরা ভারত পাড়ি দেন৷ বাবা রবি নিয়োগীর পরামর্শ মতো কলকাতায় মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার সাথে কাজ শুরু করেন৷
সংস্থার শিল্পীরা বিভিন্ন শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে শিবিরে ঘুরে ঘুরে গণসংগীত ও বিপ্লবী গান গাইতেন৷ তাঁদের মাঝে সংগ্রামী চেতনা ও উৎসাহ-উদ্দীপনা জোগাতেন৷ এছাড়া সলিল চৌধুরী, হেমন্ত ও আরতী মুখোপাধ্যায়সহ ভারতের জনপ্রিয় ও বড় বড় শিল্পীদের সাথে নানা স্থানে গান গেয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতেন তাঁরা৷ প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোতেও তাঁরা উদ্দীপনামূলক দেশ গান করতেন৷ প্রথমদিকে ট্রাকে করে এবং পরে ট্রেনে, বাসে এমনকি নৌকা করেও দূর-দূরান্তে গান গাইতে যেতেন৷ সেসময় শান্তিনিকেতনের একটি ঘটনা তুলে ধরেন তিনি, ‘‘আমরা ৬ পৌষ শান্তিনিকেতনে গান গাওয়ার জন্য গিয়েছিলাম, তখন সেখানে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা গান গেয়ে গেয়ে আমাদের সংবর্ধনা দিয়েছিল৷ তারা বলছিল যে, বাংলাদেশে যাবো, চিংড়ি খাবো৷ কিন্তু তারা কখনও চিংড়ি খেতে আসতে পারল কিনা জানিনা৷ তবে এই দৃশ্য আমাকে এখনও খুব আনন্দ দেয়৷''
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বেশ কিছুদিন গান করেছেন৷ এরপর উদীচী, খেলাঘরসহ বিভিন্ন সংগীত প্রতিষ্ঠানে গান শিখিয়েছেন এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সাথে এখনও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছেন মঞ্জুশ্রী নিয়োগী৷ তবে স্বাধীনতা যুদ্ধের সশস্ত্র সৈনিকদের কিছুটা মূল্যায়ন হলেও শব্দ সৈনিকদের কোন মূল্যায়ন হয়নি বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন তিনি৷ এছাড়া স্বাধীনতার ৪০ বছরেও দেশের তেমন কোন উন্নতি না হয়ে বরং দেশ ক্রমাগত অবনতির দিকে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন৷ এখানে জীবনের সৌন্দর্যবোধ, সুকুমারবৃত্তি লুণ্ঠিত হচ্ছে৷ একটা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে আজ দেশের মানুষ৷ এমনকি দেশ এখনও স্বাধীনতাপূর্ব তিমিরেই রয়ে গেছে বলে অভিমত মুক্তিযোদ্ধা মঞ্জুশ্রী নিয়োগীর৷
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ