মুদ্রানীতি কি মূল্যস্ফীতি কমাতে পারবে?
১৯ জুন ২০২৩তবে অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক বিশ্লেষকেরা মনে করেন এতে মূল্যস্ফীতির ওপর তেমন কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়বেনা৷ কিন্তু সুদের হার বাড়লে তাতে ছোট ঋণ গ্রহীতারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন৷ যারা বড় আকারে ঋণ নেন তাদের কোনো সমস্যা হবেনা৷ এটা নিয়ে মুদ্রা ব্যবস্থার সার্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা যাবেনা৷
এই মুদ্রানীতি ছয় মাসের জন্য৷ রোববারে ঘোষণা করা মুদ্রানীতি জুলাই থেকে কার্যকর হবে৷ আগামী মাস থেকে ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা তুলে দিয়ে নতুন পদ্ধতি চালু হবে৷ তাতে সুদের হার ১০-১১ শতাংশ হওয়ার কথা৷ আর আমানতের সুদের হার শতকরা সাত টাকা থেকে বেড়ে ৮-৯ শতাংশ হতে পারে৷
যে পদ্ধতিতে সুদের হার নির্ধারণ হবে
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার নতুন সুদের হার নির্ধারণের পদ্ধতিকে ‘শর্ট টার্ম মুভিং অ্যাভারেজ রেট' বলে আখ্যায়িত করেছেন৷ সুদের হার নির্ধারণ করা হবে ১৮২ দিন মেয়াদি সরকারি ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের গড় সুদের সঙ্গে সর্বোচ্চ তিন শতাংশ যোগ করে৷ আর সিএমএসএমই (কটেজ, মাইক্রো, স্মল, মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ) এবং ভোক্তা ঋণের ক্ষেত্রে যোগ করতে পারবে চার শতাংশ৷ বর্তমানে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার সাত শতাংশের নিচে৷ ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ট্রেজারি বিলের গড় সুদের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ যোগ করতে পারবে৷
বাজেটে (২০২৩-২৪) সরকার মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশ এবং সাড়ে সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে৷ কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবার প্রবৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশি জোর দিয়েছে৷ গত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ১৪.১০ শতাংশ ঋণ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়৷ আর আগামী ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণ ১০.৯ শতাংশ এবং অর্থবছর শেষে ১০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য দেয়া হয়েছে৷ সরকারি খাতে ডিসেম্বরে ৪৩ শতাংশ এবং আগামী জুনে ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে৷ মুদ্রা সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা আগামী ডিসেম্বরে সাড়ে ৯ এবং জুনে ১০ শতাংশ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে৷
মে মাসে সরকারি হিসেবে দেশে মূল্যস্ফীতি ছিলো ৯.৯৪ শতাংশ৷ যা গত ১১ বছরে সর্বোচ্চ৷
বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি সাধারণ নিয়মে হয়নি
সিরডাপের পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘‘চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকলে অথবা সরবরাহের তুলনায় চাহিদা বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি হয়৷ কিন্তু বাংলাদেশে এখন যে মূল্যস্ফীতি তা সেই নিয়ম মেনে হয়নি৷ ডলার সংকট এবং আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এটা হয়েছে৷ আর দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও তার প্রভাব এখানে পড়ে না৷ চাহিদা বাড়ার কারণে দাম বাড়লে টাকা সরবরাহ কমিয়ে দিলে দাম কমে৷ কিন্তু এখানে চাহিদা যে বেড়ে গেছে তা কিন্তু নয়৷''
তার কথা, ‘‘সুদের হার বাড়লে টাকার সরবরাহ কমে৷ এখন সেটা যদি ব্যাপক ভাবে করা হয় আর সরকার যদি ব্যাংক খাত থেকে ধার করে তাহলে ব্যক্তি খাত টাকা পাবে কোথায়? তাই বাস্তবে এই চিন্তা কোনো কার্যকর ফল বয়ে আনে না৷''
তিনি মনে করেন, ‘‘এভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন৷ মূল্যস্ফীতির পিছনে অনেক কারণ আছে৷ এটা রাতারাতি কিছু করা সম্ভব নয়৷ সুদ বাড়িয়ে সেটা করতে হলে আর সব কিছুর উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে৷ সেটা করলে আবার প্রবৃদ্ধি নিয়ে সমস্যা হবে৷''
ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের অর্থনীতি অনেক দিন ধরেই ভুল নীতির ওপর চলছে৷ এখন ডলারের তিন ধরনের রেট আছে৷ এটা বাজারের হাতে ছেড়ে দিলেই ঠিক হয়ে যাবে তা নয়৷ আমাদের তো ডলার ক্রাইসিস আছে৷ সেটা আগে সামাল দেয়ার পথ বের করতে হবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘সরকারের ওপর তো আরো চাপ বাড়বে৷ ২০১৫ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আমরা ৫৫ বিলিয়ন ডলার বিদেশ থেকে ঋণ নিয়েছি৷ এর ভিতরে ১৭-১৮ বিলিয়ন ডলার আছে শর্ট টার্ম লোন৷ এক সময় তো ভালো লেগেছে৷ আমাদের রিজার্ভ বেড়েছে৷ এখন তো ফেরত দিতে হবে৷ এখন কী হবে?''
সব হচ্ছে আইএমএফের প্রেসক্রিপশনে
আর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘আইএমএফ বলেছে তাই বাংলাদেশ বলল সুদের সীমা তুলে দিলাম৷ কিন্তু এটা তো আর বাস্তবে বাজার ভিত্তিক হয় নাই৷ উন্নত বিশ্বে সুদের হার দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে৷ কিন্তু আমাদের দেশে তো সেরকম নয়৷ এখানে সুদের হারের সাথে মূল্যস্ফীতি তেমন রেসপন্স করেনা৷ হয়তো সামান্য প্রভাব পড়তে পারে৷''
তার কথা, ‘‘বাংলাদেশের ৬০ ভাগ মানুষ তো ব্যাংক ঋণের মধ্যে নাই৷ ৪০ ভাগ লোক আছে আর মধ্যে বড় একটি অংশ মাইক্রো ফাইনান্স নেয়৷ এই সুদের হার বাড়ায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ যারা বড় আকারের ঋণ নেয় তারা লাভবান হবে৷ কারণ তারা ব্যাংকে সঙ্গে কথা বলে কমেও ঋণ নিতে পারবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘ব্যক্তি খাতে ঋণ কমিয়ে দেবে৷ সেটা হলে কর্মসংস্থান কীভাবে হবে৷ বাংলাদেশে ব্যক্তিখাতেই কর্মসংস্থান বেশি হয়৷ সরকার ঋণ নিয়ে কী করবে? বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে৷ এসএমই খাতে ঋণ দরকার৷ সেখানে কমে গেলেও অনেক উদ্যোক্তা কমে যাবে৷''
তিনি মনে করেন, ‘‘ডলার ও রিজার্ভ সংকট কাটাতে হলে রেমিটেন্স আরো সহজ করতে হবে, রপ্তানি বাড়ানোর উপায় খুঁজতে হবে৷ এফডিআই বাড়াতে হবে৷ ঋণ প্রবাহ বাড়াতে হবে৷ ডলার রেট বাজারের হাতে ছেড়ে দিলেই সমাধান হয়ে যাবেনা৷''
তার অভিমত, ‘‘এখন যা করা হচ্ছে তা আইএমএফের প্রেসক্রিপশন৷ তাদের ওই একই কথা, বলে সুদের হার বাড়াও, ডলার বাজারের ওপর ছেড়ে দাও৷ এই প্রেসক্রিপশন দিয়ে তো সব হবে না৷''
আইএমএফের প্রেকক্রিপশনের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর রোববার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘বাংলাদেশ আইএমএফের সদস্য৷ সদস্য দেশকে তারা বিভিন্ন পরামর্শ দেয়৷ আমরা কখনো মানি, কখনো মানি না৷ বর্তমানে বিদেশি ঋণের সুদহার আট থেকে ৯ শতাংশ৷ আইএমএফ দুই শতাংশের কম সুদে ঋণ দিচ্ছে৷ সস্তা ঋণ নিতে হলে তো কিছু কথা শুনতে হয়৷''